নওগাঁর হাঁসাইগাড়ী বিল: কৃষকবিদ্রোহ থেকে মিনি কক্সবাজারের যাত্রা

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

নওগাঁ সদর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে হাঁসাইগাড়ী ও শিকারপুর ইউনিয়নকে সংযুক্ত করেছে বিস্তৃত জলরাশি। তুলসীগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষে এই হাঁসাইগাড়ী বিল স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই 'নওগাঁর মিনি কক্সবাজার' নামে পরিচিত।

সন্ধ্যার লাল আভা যখন পানিতে রঙ ছড়ায়, ঢেউ এসে সড়কের কোলে আছড়ে পড়ে, সেই সৌন্দর্য আপনাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করবে। প্রশাসনিকভাবে এটি নওগাঁ সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত এবং হাঁসাইগাড়ী ও শিকারপুর—দুই ইউনিয়ন জুড়ে বিস্তৃত।

অবস্থান ও যাতায়াত

নওগাঁ শহর থেকে হাঁসাইগাড়ী বিলের দূরত্ব প্রায় ১০-১১ কিলোমিটার। শহরের গোস্তহাটির মোড় থেকে স্থানীয় যানবাহনে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আঁকাবাঁকা ডুবো সড়কের একপাশে চঞ্চল জল, অন্য পাশে কৃষিভূমি—এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।

শিকারপুরের খামারবাড়ী মোড় থেকে হাঁসাইগাড়ীর কাটখৈইর বাজার পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার সড়ক স্থানীয় যোগাযোগ যেমন বদলে দিয়েছে, সেই সঙ্গে খুলেছে পর্যটনের নতুন দুয়ার।

ইতিহাস: রাজা হরনাথ রায়, খাজনা বৃদ্ধি ও আস্তান মোল্লার কৃষক বিদ্রোহ

হাঁসাইগাড়ী বিলের চারপাশে আজ যতই শান্ত প্রকৃতি বিরাজ করুক, এই ভূমি এক সময় ছিল কৃষকের রক্ত-ঘামে ভেজা সংগ্রামের ক্ষেত্র। উনিশ শতকের শেষ ভাগে এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো নওগাঁর বিখ্যাত দুবলহাটি জমিদার। রাজা হরনাথ রায় চৌধুরী একদিকে ছিলেন শিক্ষানুরাগী, সমাজ সংস্কারক, অন্যদিকে খাজনা আদায়ে কড়া শাসক।

তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নাট্যশালার আয়োজন করেছিলেন, এমনকি পুকুর-দীঘি খনন করে জনসেবার দিকেও নজর দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবিক উদ্যোগের আড়ালে অনেক সময় কঠোর শাসনের কাঁটা লুকিয়ে থাকে। হরনাথ রায়ের শাসনামলে কৃষকের ঘাড়ে খাজনার বোঝা আরও ভারী হয়ে ওঠে। ফসল ভালো না হলেও খাজনা মওকুফের সুযোগ ছিল না, উল্টো জোর করে আদায় চলতো।

এই বাড়তি খাজনা আর জমিদারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৮৮৩–৮৪ সালের দিকে হাঁসাইগাড়ী অঞ্চলের সাধারণ কৃষকেরা বিদ্রোহে ফেটে পড়েন। নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, মৌলভী আস্তান মোল্লা। তিনি সাধারণ কৃষকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—"মাটি আমাদের, ঘাম আমাদের—তাহলে এই অযৌক্তিক খাজনা কেন?"

আস্তান মোল্লার নেতৃত্বে কৃষকেরা খাজনা দিতে অস্বীকার করেন, মিছিল-মিটিং করে দাবি-দাওয়া জানান। আর স্থানীয় জমিদারি প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। যদিও সেই বিদ্রোহ খুব বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েনি, তবে এটি ছিল বাংলার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রজাবিদ্রোহের ধারাবাহিকতার একটি গর্বিত অধ্যায়।

আজ হাঁসাইগাড়ী বিলের শান্ত জলে ভেসে বেড়ানো মাছরাঙ্গা বা ঢেউয়ের শব্দ হয়তো মনে করিয়ে দেয় না সেই কালের আর্তনাদ, তবে ইতিহাসের পাতায় আস্তান মোল্লার নাম থেকে যায় কৃষকের অধিকাররক্ষার প্রতীক হিসেবে।

প্রকৃতি, ঋতুচক্র ও কৃষি

হাঁসাইগাড়ী বিলে বছরে প্রায় ছয় মাস পানি থাকে, বাকি সময় ইরি-বোরোসহ রবিশস্যের আবাদ হয়। বর্ষায় বিল জলাধারের কাজ করে, স্থানীয় কৃষিজমির সেচেও এর ভূমিকা আছে। জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিনে বিলে ঢেউ খেলে যায়, দেখা মেলে পানকৌড়ির। পানি কমে গেলে ধানখেতে সবুজ হয়ে ওঠে। হেমন্তে সোনালি ধানের ঢেউ—একই দৃশ্যপটে প্রকৃতির রঙ বদলের উৎসব।

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

পর্যটন স্পট ও কী দেখবেন

বিলের বুক চিরে চলে গেছে ডুবো সড়ক। এ পথ ধরে হাঁটতে, ছবি তুলতে কিংবা কেবল গোধূলী দেখার বিকল্প হয় না। বর্ষায় ঢেউ এসে বুঝিয়ে দেবে—কেন একে 'মিনি কক্সবাজার' বলা হয়।

ভাইরাল হিজল গাছ: বিলে বুকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাচীন হিজল গাছ এখন জনপ্রিয় ফটো-স্পট। গাছটির চারপাশের প্রতিচ্ছবি মন কাড়ে।

নৌকা ভ্রমণ: বর্ষাকালে ঘণ্টাচুক্তিতে নৌকা নিয়ে বিলে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আছে। স্থানীয় মাঝিরা সাধারণত প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০০–৪০০ টাকা নেন। পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে ছোট একটি চক্রে নৌ-ভ্রমণ করলে অভিজ্ঞতাটা আরও উপভোগ্য হয়।

পদ্ম-শাপলা, হাট-বাজার ও লোকজ জীবন: ঋতুভেদে শাপলা-পদ্মের সমারোহ, পাড়ের ভ্রাম্যমাণ ফুডস্টল, আর জেলেদের দৈনন্দিন জীবন—সব মিলিয়ে এটি আসলে গ্রামবাংলার জীবন্ত জাদুঘর। ইচ্ছে করলে একই সফরে পাশের দুবলহাটি জমিদার বাড়ি ঘুরে আসা যায়।

বর্তমান অবস্থা: সুযোগ-সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা

স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এখানে পর্যটনমুখী কিছু কাজ হয়েছে—যেমন সেলফি কর্নার স্থাপন এবং সাধারণ অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ। তবে মানসম্মত রেস্টুরেন্ট, পর্যাপ্ত বসার বেঞ্চ, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের ঘাটতি রয়েছে। ছুটির দিনে দর্শনার্থীর চাপ বেড়ে গেলে ভিড়ও বেশি হয়।

২০২০ সালে বর্ষায় ঝুঁকির কারণে কিছুদিন দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়েছিল। তাই বর্ষায় বেড়াতে গেলে রাস্তায় সাবধানে চলাফেরা করাই ভালো।

ভ্রমণচাহিদা বাড়ায় স্থানীয়ভাবে শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হয়েছে—বিশেষ করে মাঝি, ক্ষুদ্র দোকানি ও হকাররা এর সুফল পাচ্ছেন। বিলে পানি কমে গেলে কৃষিকাজ, মাছধরা ইত্যাদিতে গ্রামের বহু পরিবার জড়িত। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই বিল অর্থনীতির অবলম্বন।

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

ভ্রমণের উপযুক্ত সময় ও টিপস

সেরা মৌসুম: জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিলে পানি থাকে। এ সময় নৌভ্রমণ, ঢেউয়ের শব্দ, বর্ষার এক রূপ দেখা যায়। শীতেও যেতে পারেন, তখন রাস্তার দুপাশে ফসলের সবুজ-সোনালি রঙ মন মাতাবে।

দায়িত্বশীল ভ্রমণ

স্থানীয় পরিবেশ ও জীবিকাকে সম্মান করুন—প্লাস্টিক ফেলবেন না, পানিতে সাবধানে নামুন, মাঝিদের সঙ্গে ন্যায্য দরদাম করুন, আর গ্রামবাসীর গোপনীয়তা বজায় রাখুন।

Comments

The Daily Star  | English

One killed in crude bomb blast during clash at Mohammadpur Geneva Camp

Several crude bombs exploded during the clash around 3:30am, police say

1h ago