পুরান ঢাকার স্মৃতির ঘর ‘লালকুঠি’ গিয়েছেন কখনো?

পুরান ঢাকার সরু গলিপথ পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে এগোলেই চোখে পড়ে লালচে ইটের বিশাল এক দালান। এই দালানটিই লালকুঠি, যাকে অনেকে নর্থব্রুক হল নামেও চেনেন। এক সময় এখানে জমেছিল পুরান ঢাকার সংস্কৃতির আসর, জমিদার-উচ্চবিত্তদের আড্ডা, নাটক, গান, সভা-সমাবেশ।
অথচ, এখন সেই লালকুঠি দাঁড়িয়ে আছে অজানা এক নিস্তব্ধতা নিয়ে। নেই কোনো কোলাহল, নেই কোনো আড্ডা।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, লালকুঠির নির্মাণ ইংরেজ শাসনামলে আজ থেকে প্রায় ১৫১ বছর আগে ১৮৭৪ সালে। ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড নর্থব্রুকের নামে এটির নামকরণ করা হয় 'নর্থব্রুক হল'।

তবে সাধারণ মানুষের মুখে লাল রঙের ইটের জন্য জায়গাটি চিরকাল 'লালকুঠি' নামেই পরিচিত। তবে সে সময় জায়গাটি টাউন হল নামেও পরিচিত ছিল।
ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই ভবনটিতে ঢাকার জমিদার, বণিক আর সংস্কৃতিপ্রেমীরা আয়োজন করতেন নাটক, সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের। কলকাতার প্রভাব ঢাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল এই লালকুঠিকে ঘিরে। শুধু বিনোদনই নয়, এ ছিল সামাজিক-রাজনৈতিক আলোচনারও কেন্দ্র।
১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি (ঢাকা পৌরসভা) ও পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে লালকুঠিতে সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ঢাকার সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ আর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ভিড় করেছিলেন সেই সংবর্ধনায়।

শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, এই ভবনের দেয়াল সাক্ষী থেকেছে আরও অনেক নাট্যচর্চা, সাহিত্যসভা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের। এক সময় এখানে গড়ে ওঠা জনসন হল আর সংলগ্ন লাইব্রেরি পুরান ঢাকার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি পায়।
তবে দীর্ঘদিন লালকুঠিটি অবহেলায় পড়ে থাকার কারণে তার জৌলুস হারাতে বসেছিল। সম্প্রতি লালকুঠি সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। দেয়ালের ফাটল মেরামত, ভাঙা জানালা বদল, রঙ-চঙ সব মিলিয়ে পুরোনো ভবনটিকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা চলছে। ঢাকার ইতিহাসপ্রেমীরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা রুম্মান হোসেন বললেন, 'ছোটবেলায় দেখেছি এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। পরে জায়গাটা ভগ্নদশায় চলে যায়। এখন আবার সংস্কার হচ্ছে দেখে ভালো লাগছে। আমরা চাই লালকুঠি আবারও মানুষের মিলনস্থল হয়ে উঠুক।'
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী লাবনী সরকার বললেন, 'গ্রাম থেকে ছোট বোন ঘুরতে এসেছে ঢাকায়। তাকে নিয়ে চলে গেলাম লালকুঠিতে। বর্তমানে লালকুঠির সংস্কার কাজ চলছে। তবে এখনো পুরোনো জৌলুস ধরে রেখেছে ভবনটি। আমরা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরেছি, ছবি তুলেছি।'
লাবনী সরকারের ছোট বোন লামিয়া জানান, 'লালকুঠিতে আমার প্রথম আসা। ঘুরতে ভালোই লেগেছে। যদিও সংস্কার চলছে দেখে এর আদিরূপ দেখতে পারিনি। তবে মনে হচ্ছে ঢাকার পুরোনো এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে এর ভেতর।'
নিজেকে ভ্রমণপিপাসু পরিচয় দেওয়া একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্ময় ইসলাম বলেন, 'লালকুঠি আমাদের ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক স্মৃতি। সংস্কার শেষে যদি এখানে নিয়মিত নাটক, সংগীত, সাহিত্যসভার আয়োজন হয়, তাহলে তরুণরা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হতে পারবে।'

সংস্কারের পর লালকুঠিকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন বুনছে ঢাকার মানুষ। কেউ চায় এখানে আধুনিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হোক, কেউ চায় পর্যটন আকর্ষণ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল মান্নান হাওলাদার মনে করেন, 'যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়, লালকুঠি পুরান ঢাকার এক জীবন্ত ঐতিহ্যে পরিণত হবে। শুধু স্থানীয় নয়, দেশি-বিদেশি পর্যটকও এখানে ভিড় জমাবে।'
তিনি বলেন, 'সংস্কারের পর লালকুঠির সামনের অংশ একদম ফাঁকা রাখতে হবে, যেন লালকুঠি থেকেই বুড়িগঙ্গার হাওয়া গায়ে মাখানো যায়। পাশাপাশি এখানে একটা ফুডকোর্ট দিলেও জনসম্পৃক্ততা বাড়বে। বিদেশে এ রকম ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্থানগুলোতে এ ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়।'
অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ব্যাখ্যা করে বলেন, 'ঢাকা শহরতো যানজটের শহর। তাই যখন মানুষ লালকুঠি ঘুরতে আসবে তখন যদি এখানে 'ফুডকোর্ট' পায় তাহলে বেশি সময় থাকতে পারবে, রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পাবে। অথবা লালকুঠির পাশে লাইব্রেরিতে যদি একটা ক্যাফে থাকে, তাহলে দেখা যাবে, বই পড়ছেন ক্যাফে থেকে একটা কফি অর্ডার করছেন, সতেজ হয়ে বই পড়ছেন। এভাবে স্থানটিতে জনসম্পৃক্ততা বাড়বে, তবে, সবকিছু হতে হবে পরিকল্পিতভাবে।'
Comments