বাবর আলীর লেখায়

মাউন্ট মানাসলু অভিযান

মানাসলু পর্বতের সামিট ক্যাম্প। চূড়া আরোহণ শেষে ভোরের প্রথম আলোয় তোলা। ছবি: বাবর আলী

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত মানাসলু (৮ হাজার ১৬৩ মিটার) শিখরে আরোহণ করেছেন পর্বতারোহী বাবর আলী। গত ২৬ সেপ্টেম্বর নেপালের স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এই পর্বত-শিখর স্পর্শ করেন তিনি।

'মাউন্টেন অব দ্য স্পিরিট'-খ্যাত এই পর্বতের অবস্থান নেপালের মানসিরি হিমাল রেঞ্জে। দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য মাউন্ট মানাসলু আরোহণের রোমাঞ্চকর গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন এভারেস্টজয়ী এই পর্বতারোহী। 

বাবর আলীর লেখায় 'মানাসলু অভিযানের দিনলিপি'র আজ শনিবার পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।

চলতি পথে। ছবি: বাবর আলী

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তিলচে গ্রামের লজের সামনের চিলতে জায়গাটুকুতে বিশাল সব সূর্যমুখী। সূর্যমুখীর দেখা পেলেও দেখা নেই সূর্যের। এই বীরুৎশ্রেণির উদ্ভিদের বীজ ছড়ানো আছে লজের বারান্দায়। সত্যিকার অর্থে বীজ টিপে তেল বের করা হবে। আর এদিকে সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি। রাতেও বেশ বৃষ্টি হয়েছে। লজের আশপাশের মাটির ওপর বৃষ্টির জলের নানান আঁকিবুঁকি। এমন মেঘলা দিনে মনও মেঘলা হয়ে থাকে।

সাড়ে ৭টার দিকে হাঁটা শুরু। গ্রামের মধ্য দিয়ে পথ। এদিকেও ক্যাটারপিলারের সাহায্যে রাস্তা বানানোর কাজ চলছে। নদী আমাদের সঙ্গেই চলছে। দু-পাশে পাহাড় খাড়া হয়ে উঠে গেছে আকাশে। পাহাড়ের চূড়া দেখা যায় না মেঘের কারণে। শুধু কাঁধ অবধি দেখা যায়। দেখে মনে হয় মেঘের ওপারেই স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের 'দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড'। জগতের নানান রহস্য আর আমাদের মাঝে পর্দা এই মেঘগুলো। অবগুণ্ঠন সরালেই 'হারানো পৃথিবী' খুলে যাবে চোখের সামনে।

হিমালয়ের বর্ণিল গ্রাম গোয়া। ছবি: বাবর আলী

রাস্তায় আর কোনো ট্রেকার নেই। শুধু আমরাই। বাংলাদেশের লোক গিজগিজ পথের চেয়ে কত আলাদা এ পথ। চলতে চলতে কথা হচ্ছে ক্রিসের সঙ্গে। একসময় আমেরিকান ফুটবল খেলত ও। এই দানবাকৃতির পেছনের রহস্য জানলাম। ওর সামনে ফুর্বা দাই রীতিমতো বামন। এখন ম্যারাথন দৌড়ায় ও। ম্যারাথনের বেস্ট টাইমিং সাড়ে তিন ঘণ্টা। আমেরিকান ফুটবল খেলার সময় নাকি ওর ওজন ছিল ৩০০ পাউন্ড। পথ কখনো ওপরে উঠছে, কখনো নামছে। জীবনও তো ঠিক তাই; উত্থানপতনে ভর্তি। পাইনের বনের মধ্য দিয়ে পথ। বনের ফাঁক গলে অনেক উঁচু থেকে নেমে আসেছে দুগ্ধফেনিভ জলধারা। 

সোয়া এক ঘণ্টা হেঁটে গোয়া নামক গ্রাম। অল্প কয়েকটা ছিটানো লজ গ্রামের দুই মাথায়। গ্রামের রাস্তার দুই ধারে আপেল বাগান। আপেলের মতো লালচে গালের এক তরুণী বসে আছে বাগানের পাশেই। কবিতায় সেই কবে পড়েছি, 'সমস্ত বাতিল মাটি হোক গোলাপের জননী'। এই গ্রামের লোকজন অবশ্য সমস্ত কেজো আর বাতিল মাটিকে আপেলের জননী করে রেখেছে। গোয়া নামের এই গ্রামের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৪৭০ মিটার উঁচুতে।

সাসপেনশন ব্রিজ। ছবি: বাবর আলী

পথ এখনো বেশ চওড়া। গাড়ি চলাচলের উপযোগী বিস্তার। স্থানে স্থানে ভূমিধসের চিহ্ন। ক্যাটারপিলারের ধাতব দাঁত বসে গেছে মাটি আর পাথর মেশানো পাহাড়ে। ইস্পাতের ধাতব দাঁতে তৈরি হচ্ছে রাস্তা। পথজুড়ে দেদার খচ্চরের মল দেখা গেলেও দেখা নেই প্রাণীটির। আমরা দোপেয়েরাই আছি শুধু। উঠছি ধীরে ধীরে। তানভীর ভাই আগেরদিন বেসিশহরের গাড়িতে তার ট্রেকিং পোল ফেলে এসেছে। যখন মন পড়েছে, ততক্ষণে গাড়ি অনেকদূর এগিয়ে গেছে কাঠমান্ডুর পথে। তার অস্বস্তি না হওয়ার জন্যই আমার ট্রেকিং পোল আর ব্যাকপ্যাক থেকে বের করলাম না। 

পথজুড়ে নৈসর্গিক সব দৃশ্য। ছবি: বাবর আলী

এক ফাঁকে ক্রিসকে জিজ্ঞেস করলাম লস অ্যাঞ্জেলসের অধিবাসী হিসেবে ও হলিউড মুভি দেখে কিনা। 'আগে সিনেমা দেখলেও এখন আর দেখি না। আমার বেশ কিছু বন্ধু হলিউডে কাজ করে। কিন্তু এখনকার নিউজ সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি বিনোদন দেয় আমাকে' ওর সরল উত্তর। এখানে আসার আগে ও একটা মজার ট্রেক করেছে। মরুভূমি থেকে ১১ হাজার ফুট উঠা যায় একদিনের একটা ট্রেকে। আমেরিকায় এটি জনপ্রিয় 'ক্যাকটাস টু ক্লাউড' নামে। দারুণ এই ট্রেকটা ও শেষ করেছে মাত্র সাত ঘণ্টায়। এই গল্প করার সময়ে চোখ ওর নতুন জুতোজোড়ার মতোই চকচক করছে। টানা হেঁটে করচে গ্রামে চা ব্রেক। পান করলাম আমার প্রিয় জিঞ্জার লেমন টি। মাঝে একদিন বিরতির পর মায়ের সঙ্গে ফোনে কথাও সারলাম।

ইয়াকের খুলি। ছবি: বাবর আলী

করচে থেকে বেরিয়েই সুন্দর সাসপেনশন ব্রিজ। এগিয়েই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। শতাব্দী প্রাচীন গাছের শেকড়ের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলা পথ। গাছের গায়ে লেগে আছে নানান আকৃতির মস আর ফার্ন। সূর্যের আলো প্রবেশ করতে না পারায় এখানে তাপমাত্রা বেশ কম। নানান পাখির কিচিরমিচির। একবার এক পাখির ডাক অনুসরণ করতে গিয়ে শেকড়ে পা আটকে গেল। ওই ইচ্ছা এরপরেই ত্যাগ করলাম। বেরিয়ে নদীর ধারে বেশ খোলা জায়গা। পাথরধসের চিহ্ন পথজুড়ে।

পেছন থেকে আসছে খচ্চরের বিশাল দল। আবার জঙ্গলে ঢুকতেই সামনে থেকে খচ্চরের দল। আমরা মাঝে স্যান্ডউইচ হয়ে গেলাম। এদের সাইড দিতে দিতেই বেশ সময় গেল। এই জঙ্গলে প্রচুর রডোডেনড্রন গাছ। যদিও এখন ফুলের মৌসুম নয় বলে নেপালের জাতীয় ফুলের দেখা মিলল না। পরের পথটুকু মহীনের ঘোড়াগুলির 'তোমায় দিলাম' গুনগুন করতে করতে এগোচ্ছি।

জঙ্গল। ছবি: বাবর আলী

বিশাল এক গাছের খোল দেখে থামলাম। ভেতরটা ফাঁপা। ভেতরে মানুষ দাঁড়ানোর জায়গা আছে দেখে গাছের খোলের ভেতরে গিয়ে ছবি তুললাম। খুব সম্ভবত কাঠ পাচারকারীদের কাজ। গাছের কাজের অংশটুকু নানান ছুতায় সরিয়ে নিয়েছে। তা সত্ত্বেও এই গাছ এখনো পুরোপুরি মরেনি। অবশ্য এমন ফাঁপা খোল দেখে বিশ্বজুড়ে শাসন আর শোষণে ব্যস্ত রাজনীতিবিদদের কথা মনে পড়ে গেল। দেশ ও জনগণের জানমালকে এরা নিজের মনে করে এমন ফাঁপা খোল বানিয়ে ফেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

পথমধ্যে শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এরপরেই ফের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। কিছু জায়গায় পাথুরে সিঁড়িও আছে। সিঁড়ি দেখে তানভীর ভাই ট্রেকিং পোল চেয়ে নিলেন। সিঁড়ির অংশ শেষ হতেই কাদায় জীবন জেরবার। বকের মতো পা ফেলে ফেলে কাদা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। রাস্তায় প্রচুর খচ্চর। এদের পাশ কাটাতে দিতে নানান কসরত করতে হচ্ছে। খচ্চর কিংবা চমরী গাইকে পাশ কাটাতে হলে পাহাড়ে সবসময় দেয়ালের দিকে থাকতে হয়। খাদের দিকে দাঁড়ালে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। এসব অবুঝ প্রাণীর মেরুদণ্ডের দুপাশে থাকা বোঝার সঙ্গে অসাবধানতাবশত লেগে গেলে খাদে পড়ে যাবার সম্ভাবনা।

গাছের ফাঁপা হয়ে যাওয়া খোল। ছবি: বাবর আলী

১২টার কিছু পরে পৌঁছে গেলাম চাউলি খারকা। এখানে দুপুরের খাবারের বিরতি। সেভেন সিস্টার লজের মালিক গুরুং ভদ্রলোক। আর তার সাত কন্যার নামে এই লজের নাম। গুরুংদের ঘরে ভগবান বুদ্ধের সঙ্গে নৈবেদ্য পান গণেশ, শিবসহ সনাতন ধর্মের অন্যান্য দেবতারাও। ডাল-ভাত খেয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ফের হাঁটা। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ। এই পথে জঙ্গল আরও ঘন। হাঁটা শুরু করতেই ফের বৃষ্টি। তীব্রতা বাড়ায় গায়ে চাপাতে হলো পঞ্চো। মেঘ-কুয়াশা এসে দৃষ্টিসীমা একদম কমিয়ে এনেছে। 

আপেল বাগান। ছবি: বাবর আলী

এক জায়গায় মিলারেপা গুহা যাবার পথনির্দেশক চোখে পড়ল। তবে সেখানে যেতে ঠিক কত সময় লাগে সেটা সঙ্গের কেউ জানে না। তিব্বতের প্রাণপুরুষ এই মিলারেপা। বলা হয়, সনাতন ধর্মের লোকের কাছে রামায়ণ-মহাভারতের অধিষ্ঠান যে আসনে, তিব্বতের অধিবাসীদের কাছে মিলারেপার জীবনীর অবস্থান ঠিক সেই মর্যাদার। মিলারেপার সঙ্গে যোগ আছে বাঙালি অতীশ দীপংকরেরও। মিলারেপার গুরু মারপার অন্যতম শিক্ষাগুরু ছিলেন বঙ্গ-সন্তান অতীশ। তিব্বতীয় পুরাণে বলা হয়ে থাকে, সেই যুগে মিলারেপা খালি পায়ে আরোহণ করেছিলেন শিব-পার্বতীর আবাস কৈলাসে। সর্বত্যাগী এই যোগীর গুহা এই যাত্রায় দেখা হলো না।

ফেলে আসা তিলচে গ্রাম। ছবি: বাবর আলী

গেসমেন খুব অবাক হলো আমি মিলারেপাকে চিনি দেখে। ও বলছিল সবার মিলারেপার মতো হওয়া উচিত; বস্তুত ওর নিজেরই মিলারেপার মতো হওয়ার চেষ্টা করা সমুচিত। কিন্তু ট্রেইলে আসলেই স্থানীয় পানীয় রক্সি আর ছাংয়ের লোভে পড়ে এই কামনায় নিবৃত্তি হয় ওর। তার ওপর সংসার ওকে বেঁধে ফেলেছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। এই হৃদয়হীন চক্র থেকে মুক্তি কই? জীবনের চিরন্তন ধারা থেকে বেরিয়ে আসা মোটেই সহজ নয়। অল্প হেঁটেই হাবু। একটা ছোট্ট টি শপ আছে এই জায়গায়। উচ্চতা ৩ হাজার ৪০০ মিটার। চায়ের আড্ডায় বসে এখানেই আমাদের ঘণ্টা পার হয়ে গেল।

ফের পথে নেমে মূল রাস্তার বদলে আমরা চোরবাটোর পথ ধরছি। চোরবাটোর ইংরেজি প্রতিশব্দ শর্টকাট। শর্টকাটের পথে রাস্তা খাড়া হলেও দূরত্ব অনেকটুকু কমে যায়। হিমালয়ের মাল বাহকরাই মূলত এসব পথ বানায় এবং ব্যবহার করে। এখানে জঙ্গলের পথে কাদার সঙ্গে পাথরেরও আধিক্য বেড়েছে। চোরবাটোর পথ ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে বিশাল এক ঝিরির কাছে চলে এলাম। প্রথম দিনের হাঁটাতে সবাই বেশ পরিশ্রান্ত। তানভীর ভাই আর ক্রিস বেশ খানিকটা পেছনে পড়েছে। ওরা আসতেই ফের পা চালালাম। আগের কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এই ঝিরি রীতিমতো ফুঁসছে। সাসপেনশন ব্রিজের পাশাপাশি ঝিরির সংকীর্ণ অংশে কাঠের একটা সেতু আছে। এগিয়েই পথের ধারে সি বাকথর্নের গাছ। এই গাছের ফল থেকে বানানো জুস হিমালয়ের ট্রেকের নানান লজে বেশ জনপ্রিয়। সাদা চামড়ার লোকেরাই এর কদর করে বেশি। 

চলতি পথের নদী। ছবি: বাবর আলী

ফুঁসতে থাকা ঝিরির পর থেকে গাছের আকার ছোটো হয়ে গেছে। মূলত গুল্মের আকার নিয়েছে এদিকের গাছপালা। দুই পাশে সবুজ ঝোপকে সঙ্গী করে কিছুদূর এগোতেই বিশাল এক ভূমিধসের এলাকা। পুরো পাহাড় ভেঙে নেমে এসেছে। ওই রাস্তা দিয়ে পেরোতে হবে চিন্তা করেই মেরুদণ্ড বেয়ে সরীসৃপ নেমে যাবার অনুভূতি হলো। একটু বাদে অবশ্য ভুল ভাঙল। আমাদের আজকের গন্তব্য ভীমথাংয়ের রাস্তা এগিয়েছে অন্যদিকে। এখান থেকে ভীমথাংয়ের অবস্থান দূরে নয়।

অতি উচ্চতায় ভলিবল। ছবি: বাবর আলী

বৃষ্টি থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে৷ এখন পুরো চরাচরে মেঘ-কুয়াশার রাজত্ব। দৃষ্টিসীমা কুড়ি ফুটে এসে ঠেকেছে। গ্রামে প্রবেশের মুখে একটা স্তূপ। ওটা পেরিয়ে যেতেই কানে এলো ধুপধাপ শব্দ। ভালোমতো কান পাততেই বুঝলাম ভলিবল খেলার শব্দ। খেলোয়াড়ের দল ৩ হাজার ৭০০ মিটার উচ্চতায়ও থেমে নেই। অবশ্য ৪ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতার আমা দাবলাম বেস ক্যাম্পেও মহাসমারোহে ভলিবল ম্যাচ হতে দেখেছি। গ্রামের প্রবেশপথের প্রায় মুখেই হিমালয়ান ভিউ লজে আজকের রাত্রিবাস। ততক্ষণে সন্ধ্যা হামাগুড়ি দিয়ে প্রায় সমাগত। এই লজের নতুন বানানো ডাইনিংয়ে এখনো কাচ লাগানো হয়নি। হাওয়া খুব বেশি কামড় বসাতে পারছে না গোবরের জ্বালানি দিয়ে চালিত হিটারের কারণে।

 

Comments