বাবর আলীর লেখায়

মাউন্ট মানাসলু অভিযান

মানাসলু পর্বতের সামিট ক্যাম্প। চূড়া আরোহণ শেষে ভোরের প্রথম আলোয় তোলা। ছবি: বাবর আলী

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত মানাসলু (৮ হাজার ১৬৩ মিটার) শিখরে আরোহণ করেছেন পর্বতারোহী বাবর আলী। গত ২৬ সেপ্টেম্বর নেপালের স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এই পর্বত-শিখর স্পর্শ করেন তিনি।

'মাউন্টেন অব দ্য স্পিরিট'-খ্যাত এই পর্বতের অবস্থান নেপালের মানসিরি হিমাল রেঞ্জে। দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য মাউন্ট মানাসলু আরোহণের রোমাঞ্চকর গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন এভারেস্টজয়ী এই পর্বতারোহী। 

বাবর আলীর লেখায় 'মানাসলু অভিযানের দিনলিপি'র আজ মঙ্গলবার পড়ুন চতুর্থ পর্ব।

লারকে পাসে, সঙ্গে ত্রিস ও ফুর্বা অংডি। ছবি: বাবর আলী

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গুরুংসেনি লজের ডাইনিংয়ের কাঠের দেয়াল নানান দেশের বিচিত্র মানুষের মনের ক্যানভাস হয়ে উঠেছে। কত রকম লোক যে কত উপায়ে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে গেছে। বেশিরভাগের লেখাতেই এখানে পৌঁছানোর উচ্ছ্বাস। লারকে পাস আর মানাসলু বেস ক্যাম্প সফলভাবে ট্রেক করার আনন্দই মূলত হরেক ভাষার বিচিত্র হরফে লেখা হয়েছে। 'অমুক-তমুক ওয়াজ হিয়ার অন তমুক ডেট' এর পাশাপাশি কয়েকজনের লেখা বেশ নজর কাড়ল। একজন লিখেছে, 'গ্রিড কামস ফ্রম হার্ট টু ম্যানিপুলেট ট্য ব্রেন'। রাশিয়ার লোকজন লিখে রেখেছে, 'ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ'। ঠিক নিচেই কেউ একজন রগড় করে লিখেছে, 'ইয়েস, ইউ লাভ ওয়ার, উই গেট দ্যাট'। ইউক্রেনের একজন লিখেছে, 'মে জাস্ট পিস প্রিভেইল'। লারকে পিকের উচ্চতা (৬ হাজার ২৪৮ মিটার) লিখে একজন লিখেছে, 'প্লিজ গড এলাউ মি টু দ্য পিক'। 

অপার্থিব সব ভোর হিমালয়ের বুকে। ছবি: বাবর আলী

ভোরে উঠলাম ৫টায়। ৫ হাজার ১০৬ মিটার উঁচু লারকে পাস আজ পেরোতে হবে বলে এত সকালে বিছানানন্দ ছেড়ে বেরোনো। তানভীর ভাই বেরিয়েছে আরও আগেই। উনি ৪টায় ঘুম থেকে উঠে ৫টা নাগাদ পথে। ওনার ক্লাইম্বিং গাইড ফুর্বা অংডি শেরপা আগেরদিনই ঠিক করে রেখেছিল তানভীর ভাইকে নিয়ে আমি আর ক্রিসের চেয়ে এক ঘণ্টা আগে বেরোবে। ক্রিস আর আমার পথপ্রদর্শক গেসমেন তামাং। আমার ক্লাইম্বিং গাইড বীরে তামাং ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছে বেস ক্যাম্পে। মূল শিবিরে পৌঁছানোর আগে ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ৫টায় উঠে বেরোতে বেরোতে প্রায় ৬টা। ততক্ষণে পুবাকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তার আগে সকালের নাশতা সেরে পথের জন্য লাঞ্চও নিয়ে নিলাম। অবশ্য লাঞ্চ বলতে তিব্বতি রুটি আর ভেজ অমলেট। পথে সুবিধাজনক জায়গা দেখে লাঞ্চ করে নেব।

গন্তব্য দূরের ওই সামদো গ্রাম। ছবি: বাবর আলী

ভোরের আবছা আলোতে পথ চলতে মোটেই বেগ পেতে হচ্ছে না। অন্ধকার সবে পালাই-পালাই করতে শুরু করেছে। সাদা বালু বিছানো পথ ধরে চলা। এই সাদা বালুর জন্যই হিমবাহ থেকে নেমে আসা বেশিরভাগ নদীর জলের রং সাদা। হাতের বামে বিশাল গ্লেসিয়ারের ধ্বংসাবশেষ। একসময় নিশ্চয়ই নিচের জনপদ অবধি ছিল এর বিস্তার। স্থানে স্থানে তৈরি হয়েছে গ্লেসিয়াল পুল। ইংরেজি হরফ 'জেড' এর আকার নিয়ে পথ ধীরে ধীরে ওপরে উঠে গেছে। এই পথই আমাদের নিয়ে যাবে লারকে পাসে। ৪ হাজার ৩০০ মিটার থেকে ৫ হাজার ১০৬ মিটার অবধি টানা উঠা। অবশ্য এখানেই শেষ নয়; আজ আমরা নেমে যাব ৩ হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতার সামদো গ্রামে। পথে কিছুদূর অন্তর অন্তর লম্বা লাল-কালো ধাতব দণ্ড পোঁতা। এই পথে কেয়ার্ন বা রুট মার্কারের স্থান নিয়েছে এই ধাতব দণ্ডগুলো। শীতে এই অঞ্চলে প্রচুর তুষারপাত হয় বলে ট্রেকিং/ক্লাইম্বিংয়ের মৌসুমে পথনির্দেশের কাজ করে এই ধাতব যষ্টিগুলো। কিছু লোহার দণ্ডের গায়ে আবার এক ফুট পরপর মার্ক করা আছে। এগুলো দিয়ে তুষারপাতের পরিমাণ দেখা হয়। 

গ্রামের নাম ধর্মশালা। ছবি: বাবর আলী

আমাদের ঠিক আগে আগে চলছে দুই পোলিশ ভদ্রলোক। ওরা আমাদের মতো মানাসলু শিখর ছুঁতে এসেছে। তবে ইংরেজিতে সড়গড় না হওয়ায় ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ এগোচ্ছে না। টানা চড়াই ভাঙতে ভাঙতে এক জায়গায় খানিকটা সমতল পাথর পেয়ে কিছুক্ষণের বিরতি। আমাদের ফেলে আসা পথ ততক্ষণে মেঘের সমুদ্রের আড়ালে। এখন কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছে ঠিক নিচেই কয়েকটা লজের সমন্বয়ে ছোট একটা গ্রাম আছে। গেসমেন বিশাল এক ড্রোন বের করল ওর ব্যাকপ্যাক থেকে। মেঘের কারণে ড্রোন বেশ কিছুদূর ওপরে উঠিয়েও কাঙ্ক্ষিত ফুটেজ পায়নি ও। ড্রোনাচার্য থাকলে হয়তো পছন্দসই ফুটেজ নিয়েই ফিরতে পারত ও।
  
আবার হাঁটা শুরু করতেই বিকট শব্দ। মেঘের চাদরে চারপাশ ঢেকে থাকায় এই গর্জনের উৎস পাথরধস নাকি তুষারধস সেটা ঠাহর করা গেল না। পরের চড়াইটা ভাঙতেই তানভীর ভাই আর ফুর্বা দাইয়ের দেখা পেলাম। চড়াইতে তানভীর ভাই বেশ ভুগছে। আমার সঙ্গে থাকা ক্যান্ডিগুলো দিয়ে দিলাম। চড়াই ভাঙার সময় মুখে কিছু থাকলে কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়। ওদের পেছনে রেখে এগোতে থাকলাম। পথেই বেশ কয়েকটা লোমশ চড়ুইয়ের দেখা। ট্রেকারদের ফেলে যাওয়া খাবারের অবশিষ্টাংশ খুঁটছে। চড়ুই দেখতে দেখতে চড়াই ভাঙছি। একটা জায়গায় এত উচ্চতায় প্রায় ফুটবল মাঠের সমান সমতল জায়গা দেখে বেশ অবাক হলাম। এই পাথরের রাজ্যে এমন সমতল জায়গা সহজে দেখা যায় না। পরের চড়াই ভাঙতেই ক্রিসের চড়া আওয়াজ। ওর ধারণা এটাই লারকে লা বা পাস। মেঘ-কুয়াশার ফাঁক গলে খানিকটা দূরে পতপত করে উড়তে থাকা প্রার্থনা পতাকা দেখিয়ে ওকে নিবৃত্ত করলাম। 'ইউ স্পয়েলড মাই সেলিব্রেশন' ক্রিসের কণ্ঠে হতাশা। 

গ্রামের নাম সামদো। ছবি: বাবর আলী

সকাল ৮টা কুড়ির দিকে লারকে পাসে। ভীমপরাক্রম ক্রিস পাসের ওপরে উঠে বেশ উৎফুল্ল। পাস আর কল-এই দুটো গুলিয়ে ফেলে এমন লোকের সংখ্যা অনেক। কল হলো দুটো পর্বতের মধ্যবর্তী রিজ বা গিরিশিরার সর্বনিম্ন বিন্দু। এভারেস্ট আর লোৎসের মধ্যবর্তী সাউথ কলকে কলের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা যায়। আর মাউন্টেন পাস মূলত মাউন্টেন রেঞ্জের এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। পাহাড়কেন্দ্রিক সে যুগের বাণিজ্যিক রুটে পাসের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। লবণ বাণিজ্যের স্বর্ণযুগে তিব্বত আর নেপালের মধ্যে পর্বতে যোগাযোগের মূল মাধ্যম ছিল পাসগুলো।

পাসের ওপরে বেশ খানিকক্ষণ বসলাম। অতি উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যও এখানে কিছুটা সময় কাটানো জরুরি। পাসের তিন জায়গায় প্রেয়ার ফ্ল্যাগ লাগানো। ঘুরেফিরে তিন জায়গাতেই গিয়ে চারপাশে চোখ বুলালাম। একদম কোণার দিক থেকে নিচের দিকে তাকালে গ্লেসিয়ারের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। খানিকক্ষণ বাদেই তানভীর ভাই আর ফুর্বা দাই এলো। পাসের অদূরেই এক জায়গায় অনেকগুলো হাড়গোড় পড়ে রয়েছে। আকার-আকৃতি দেখে বুঝলাম এগুলো ঘোড়ার কিংবা খচ্চরের হাড় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। 

নুব্রি দাদি। ছবি: বাবর আলী

৯টার দিকে লারকে পাস থেকে ফের চলতে শুরু করলাম। অল্প এগিয়েই বিশাল এক লেক। একটা হলুদ তাঁবু লাগানো আছে লেকের ধারে। হাঁটছি মোরেইনের মধ্য দিয়ে; উতরাই পথ। টানা নামতে থাকা। চারপাশে খুব একটা দ্রষ্টব্য কিছুই নেই; একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। আর কিছুদূর এগিয়ে তুষার-রেখা ছাড়িয়ে ট্রি-লাইনে পা রাখলাম। হরেক রকম সবুজ যেন আমাদের স্বাগত জানাল। এখন আর একঘেয়ে দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি নেই। প্রকৃতি পরতে পরতে তার সব শোভা আমাদের বুভুক্ষু চোখের সামনে মেলে ধরেছে। 

ঘণ্টা দেড়েক নেমে ব্লু লেক। আক্ষরিক অর্থেই পানি নীল। সেই নীল পানিতে পেছনের ধূসর হিমবাহ আর শুভ্র পর্বতকে বুকে ধরেছে এই হ্রদ। এখানে বেশ কিছুটা সময় থামা হলো। হাঁটা শুরু করে কয়েক কদম যেতেই ওপাশ থেকে আসা খচ্চরের দলকে পাশ কাটাতে দেওয়ার জন্য থামতে হলো ফের। ওই পর্ব সাঙ্গ করে পা চালাতেই হালকা একটা চড়াই। এরপর থেকে টানা উতরাই। এ যেন অন্তহীন নামা। নামতে নামতে পায়ে খিল ধরার দশা। অবশ্য পথের দুঃখ-কষ্ট থাকবেই। তীর্থযাত্রীর মতোই সেগুলোকে আপন করেছি আমি। বিশালকে কাছে পেতে হলে এসব ক্ষুদ্র ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়। তবে অভিযানের কষ্টগুলো স্থায়ী হয় না। দিনশেষে মনের গহীনে আনন্দটুকুই জমা থাকে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পুলক বাড়তে থাকে পরিধিতে। এই আনন্দ কোনো স্কেলে ফেলে মাপা যায় না কিংবা ক্যামেরাবন্দি করা যায় না। 

ইয়াক কিংবা ঘোড়ার হাড়। ছবি: বাবর আলী

জুনিপারের ছোটো ছোটো ঝোপের মধ্য দিয়ে আরও ঘণ্টাখানেক নেমে ধর্মশালা। সবুজ পাহাড়ের পটভূমিতে লালচে টিনের কয়েকটা লজ নিয়ে এই ধর্মশালা জায়গাটি। লজের ডাইনিংয়ের জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই অল্প দূরে দেখলাম হিমালয়ান মাস্ক ডিয়ারের একটা পরিবার। ছবি তোলার চেষ্টা করে সুবিধা করা গেল না। এখানের ডাইনিংটা বেশ জমজমাট। নানান দেশের নানান বয়সী লোকেদের ছোটোখাটো মেলা। জেনি নামে এক সুইস মেয়ে ক্রিসের সঙ্গে গল্প করছিল। কৌতূহলবশত ক্রিসকে জিজ্ঞেস করল ও এভারেস্ট চড়েছে কি না। ক্রিস আমাকে দেখিয়ে বলল, 'আমি না চড়লেও ও চড়েছে'। জেনি ফট করে বলে বসল, 'ওর কথা আলাদা। ও নিশ্চয় দশ হাজার ফুট কিংবা বেশি উচ্চতার কোনো গ্রামে জন্মেছে'। আমাকে নেপালি ঠাহর করে যে ও ভুল করেছে সেটা বুঝিয়ে দিলাম। আর সঙ্গে এও জানিয়ে রাখলাম, আমার জন্ম একেবারে সমুদ্র সমতলের চট্টগ্রামে। জেনি আর ওর ফরাসি বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বেশ জমে গেল। বাকি জীবনে ওদের সঙ্গে আর কখনো দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক সময় যে কীভাবে পেরিয়ে গেল ঠাহরই করতে পারলাম না। গল্পের ফাঁকে লারকে ফেদি থেকে নিয়ে আসা প্যাকড লাঞ্চের সঙ্গে খেলাম ভেজিটেবল থেন্টুক। ট্রেকপথে থেন্টুকের অপর নাম শেরপা স্টু।

চলছে চড়াই ভাঙা। ছবি: বাবর আলী

ডাইনিং থেকে শরীর-মন উঠিয়ে ট্রেইলে নামলাম। তানভীর ভাইকে নিয়ে ফুর্বা যথারীতি কিছুটা আগেই বেরিয়ে গেছে। কিছুদূর যেতেই ক্রিসের মুখ থেকে 'এফ' আদ্যক্ষরের প্রজনন-সম্পর্কীয় চার অক্ষরের ইংরেজি শব্দ শোনা গেল। ঘটনা হলো, ট্রেক শুরুর পর গত তিনদিনে তিনটা টয়লেট টিস্যু হারিয়েছে ও। সর্বশেষ টয়লেট টিস্যু ও ধর্মশালাতেই কিনেছে। একবার ব্যবহার করেই সেটা টয়লেটে ফেলে এসেছে। ধর্মশালার টিস্যুটাই বেশি কষ্ট দিয়েছে ওকে। অবশ্য টিস্যু নয়, টিস্যুর দাম। যত উচ্চতা, তত দামের নিয়ম মেনে আগের দুটি রোলের চেয়ে চড়া টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে টিস্যু। মন খারাপ করে বলেই ফেলল, 'লিটারেলি ক্যান্ট এফোর্ট দ্যাট শিট এনিমোর'।

পথের পরে পাওয়া সৌন্দর্য। ছবি: বাবর আলী

ধর্মশালা থেকে মূলত মাটির রাস্তা, মাঝে ছোপ ছোপ ঘাস। নিচে তাকালেই হিমবাহ থেকে নেমে আসা সুন্দর একটা ঝিরি চোখে পড়ে। চারপাশের দৃশ্য অপূর্ব সুন্দর। মেঘের দলের অন্তহীন ওড়াউড়ি। একটা বাঁক ঘুরতেই অনেক নিচে আজকের গন্তব্য সামদো উঁকি দিলো। সবুজ ঘাসের জমিনে ছোট্ট একটা বৈঠকখানাকে ঘিরে মালবাহকদের দল চাক বেঁধেছে। ফোন হাতে উত্তেজিত সবাই। এই জায়গায় এনটিসির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ঘটনা জিজ্ঞেস করে জানলাম, আন্দোলনের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। নানান উড়ো খবর শুনলাম ওদের কাছ থেকে। ওদের আড্ডা ছেড়ে পা চালিয়ে যতই সামনের দিকে যাচ্ছি, সামদো গ্রামটি ততই বড়ো আর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গ্রামে ঢোকার আগে সাসপেনশন ব্রিজের ওপাশে এবারের যাত্রায় প্রথম ইয়াকের দেখা মিলল। ব্রিজের এপাশে পুরনো গ্রাম ছিল। তারই নানান ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। বিশাল সাইজের একখানা মারমট দেখে প্রথমে পিলে চমকে গেল রীতিমতো। বোঝাই যায় ওদের অন্নের সংস্থান এই জনপদে ভালোই হয়। পথের ধারে স্থানে স্থানে বেশ অনেকগুলো মারমটের গর্ত। 

ব্লু লেক। ছবি: বাবর আলী

আড়াইটার দিকে সামদো গ্রামে। তানভীর ভাই আর ফুর্বা দাই আমাদের একটু আগেই পৌঁছেছে। নৈশাশ্রয়ের জন্য উঠে পড়লাম টিবেটান টুইন লজে। ক্রিস এসেই গরম পানির জোগাড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে; গোসল সারবে ও। তাই দেখে রিনজে বলে উঠল, 'মাউন্টেন ম্যায় জো গান্দা, ও জিন্দা' (পাহাড়ে যে নোংরা থাকে, সে-ই বেঁচে থাকে)। আসার পর থেকে সবার হাতে ফোন। এই জায়গায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। গতকালের ঘটনার নানান ভিডিও দেখছে সবাই। সরকারের পক্ষে সুযোগ ছিল সমঝোতা করার; সময়মত সেটা না হওয়ায় তা রূপ নিয়েছে সংঘাতে। যেকোনো আন্দোলনের উত্থানই হয় বঞ্চনাকে উপজীব্য করে; এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিম্নচাপ ছিল, সেটাই বিধ্বংসী ঝড়ে পরিণত হয়ে সরকারের পতন হলো। আর এই পুরো ঘটনার 'আই অব দ্য সাইক্লোন' কাঠমান্ডু। 

রুট মার্কার বা তুষার পরিমাপক ধাতব দণ্ড। ছবি: বাবর আলী

রাজনীতির নীতিনির্ধারকরা সাধারণত কেন্দ্রের চোখ দিয়ে দেখেন রাজধানী থেকে দূরে থাকা প্রান্তে বসবাস করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই দৃষ্টিতে মিশে থাকে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা। এবার নেপাল-তিব্বত সীমান্তে বসে আমরা প্রান্তের দৃষ্টিতে দেখছি রাজনীতির ভরকেন্দ্র রাজধানীকে। পরের শাসক কে হবে সেটা নিয়েই সবার মধ্যে জল্পনা-কল্পনা। কাঠমান্ডুর তরুণ ও জনপ্রিয় মেয়র বালেনের বাক্সেই আমাদের দলের সবার ভোট। মজার ব্যাপার হলো, মেয়র হবার আগে বালেনের কোনো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিল না। প্রথাগত রাজনীতির ওপর ত্যক্ত হয়েই মেয়র নির্বাচন করেছিল সে। মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক প্রাণী। দিনশেষে তার হয়ে যারা সিদ্ধান্তগুলো নেয়, তাদের নিয়ে লোকের কিছু না কিছু বলার থাকেই। 

 

Comments