মাউন্ট মানাসলু অভিযান
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত মানাসলু (৮ হাজার ১৬৩ মিটার) শিখরে আরোহণ করেছেন পর্বতারোহী বাবর আলী। গত ২৬ সেপ্টেম্বর নেপালের স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এই পর্বত-শিখর স্পর্শ করেন তিনি।
'মাউন্টেন অব দ্য স্পিরিট'-খ্যাত এই পর্বতের অবস্থান নেপালের মানসিরি হিমাল রেঞ্জে। দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য মাউন্ট মানাসলু আরোহণের রোমাঞ্চকর গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন এভারেস্টজয়ী এই পর্বতারোহী।
বাবর আলীর লেখায় 'মানাসলু অভিযানের দিনলিপি'র আজ শুক্রবার পড়ুন প্রথম পর্ব।
৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
হোটেল মুনলাইটের মাথার ওপর থাকা চাঁদের আলো যে একটু সুস্থির হয়ে উপভোগ করব, সে উপায় নেই। আগের রাতে দশরথ রঙ্গশালা থেকে নেপাল বনাম বাংলাদেশের ফুটবল ম্যাচ দেখে ফেরার পথে পড়েছিলাম বৃষ্টির কবলে। অবশ্য এই বৃষ্টি খানিকটা শাপে বর হয়েছে। চায়ের জন্য এক দোকানে থামতেই পরিচয় হলো দোকান মালকিনের সদা-চঞ্চল ছেলে অতীতের সঙ্গে। গায়ে কাঠমান্ডুর ফুটবল দল সংকটা এফসির জার্সি। বয়স ৯ হলেও সে খেলে অনূর্ধ্ব-১২ দলে। আগে ছিল গোলরক্ষক, এখন পুরোদস্তুর ফরোয়ার্ড। এমন মেটামরফোসিস খোদ ফ্রানৎস কাফকা সাহেব গ্রেগর সামসাকে দিয়ে করাতে পারতেন কিনা সন্দেহ!
খেলাধুলা নিয়ে প্রচুর কথাবার্তার ফাঁকে ওর এন্তার আগ্রহ বাংলাদেশের জাতীয় পশু, জাতীয় পাখি, জাতীয় ফল নিয়ে। আমি ফোন ঘেঁটে ছবি দেখিয়ে ওর কৌতূহল নিবারণ করলাম। ফুটপাতের ওপর চিলতে দোকানের ওপরেই থাকে মা-বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে। ক্লাব ফুটবলে আমার প্রিয় ক্লাবের নাম জিজ্ঞেস করে একবার আমাকে রীতিমতো চুপসে দিলো। আমার মিনমিন করে উচ্চারণ করা 'ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড' এর বদলে ও উপহার দিলো চাপা হাসি। অবশ্য ওকে দোষ দিয়ে লাভ কী। নিজের সমর্থকদের নাক কাটার সমস্ত ব্যবস্থা রেড ডেভিলরা আগেই সেরে রেখেছে।
অতীতকে ওর মা ডাকে 'খিলাড়ি' বলে। চিলতে দোকানের দেয়ালেই বল পায়ে কারিকুরি করে ও। ফেরার সময় ওকে বলে আসলাম, 'আমি তোমাকে নেপালের জাতীয় দলের হয়ে খেলতে দেখতে চাই। আমি তোমাকে টিভিতে দেখব।'
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি থেমে যাবার পর চাঁদের ঠান্ডা আলোতে কাঠমান্ডুর পথঘাট ধুয়ে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে তো আর আকাশের দিকে খুব বেশি তাকানো যায় না। কাঠমান্ডুর ফুটপাতের হরেক রকম গর্ত এড়ানো আর পেরোনোর সময় আকাশের দিকে তাকালে দূর আকাশের তারা হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। তার ওপর 'মায়ের শেষ ছেলে' হিসেবে পরিচিত বেপরোয়া মোটরবাইক চালকরা তো আছেই। একটু অসাবধান হলেই এদের চাকার সামনে পড়ে ভূতলশায়ী হয়ে গোরস্থান কিংবা হাসপাতাল যাত্রা নির্ঘাত। তাই ফিরতে ফিরতেই যতটুকু পারা দেখে নেওয়া।
আমাদের আবাস থামেল থেকে স্টেডিয়ামের দূরত্ব সাড়ে ৩ কিলোমিটার। 'আরে মাত্র ২ কিলোমিটার রাস্তা। এক স্প্রিন্ট দিলেই পৌঁছে যাবেন' বলে তানভীর ভাইকে ফুসলিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে নতুন রাস্তা ধরে ফেরার মুলা ঝুলিয়ে ওনাকে ফের হাঁটালাম। এরপর পর্বতে নিজেদের অবস্থান কাছের মানুষদের জানানোর জন্য ব্যবহৃত গার্মিন ইনরিচ মিনি ২ এর নানান ফিচার আর ম্যানুয়াল পড়তে পড়তেই বেশ রাত। এক ফাঁকে ব্যাক-প্যাক আর ডাফল ব্যাগও গোছাতে হলো। এত কিছুর ফাঁদে আর চাঁদের দিকে তাকানোর সুযোগই মেলেনি।
হোটেলে আমাদের কক্ষ থেকেই একটা অশ্বত্থ গাছ কিংবা বোধিবৃক্ষের পাতা ছোঁয়া যায়। লম্বা লেজওয়ালা এই পাতা দেখলেই বৈরাগী মন ভালো হয়ে যায় আমার। সকাল ৬টার দিকে উঠে সাড়ে ৬টা নাগাদ নাশতার টেবিলে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই দেখলাম আমাদের অভিযান আউটফিটার স্নোয়ি হরাইজনের স্বত্বাধিকারী বোধা রাজ দাঁড়িয়ে আছে বোধিবৃক্ষের গা ঘেঁষে। গাড়ির ছাদে ব্যাগ বাঁধার কাজ শেষ করে পৌনে ৮টার দিকে বেসিশহরের পানে রওনা হয়ে গেলাম সবেগে।
বেসিশহরের নাম শুনলেই আমার চোখে ভাসে কয়েক বছর আগের অভিযান থেকে ফেরার দৃশ্য। ফরহান ভাই, তানভীর ভাই আর আমি সেবার একটা অভিযান শেষে গাড়িতে চেপে বসেছি। পুরো ৬ ঘণ্টার জার্নিতে একটা গানই বাজিয়েছিল চালক। গানের নাম 'বোতল কো পানি লে'। কাঠমান্ডুতে ফেরার পর আমাদের প্রথম কাজই ছিল ইউটিউবে এই গানটা সার্চ করা। গানের ভিডিও দেখে আর শুনে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ-ভঞ্জন হয়েছিল সেবার। অবশ্য এমন লুপের মতো গান শোনার অভ্যাস আমার নিজেরও আছে।
ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার 'ফ্লাই মি টু দ্য মুন' কিংবা কারপেন্টারসের 'টপ অব দ্য ওয়ার্ল্ড' মাঝে মাঝেই আমার প্লে-লিস্টে লুপের মতো বাজতে থাকে। অনেক বছর আগে অবশ্য আরেকটা গান ট্রেকে আমার সঙ্গীদের কানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। 'এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা' গানটা শুনতে শুনতে ট্রেকে আসার আগেরদিন এক মানববন্ধনে পরিচিতার কথাই বারবার ঘুরেফিরে মনে আসছিল। ৮ দিন বাদে নেটওয়ার্কে ফেরার পর মাকে ফোন করতে ফোন হাতে নিতেই ওই পরিচিতার ফোন ভালোই বিস্মিত করেছিল। তখনো অবশ্য ঘর-সংসারের মায়াজালের চেয়ে জগৎ-সংসার দেখাটা আমার কাছে অধিক আবেদনময়ী। পরে পাল্লা একদিকে ভারী হতে শুরু হওয়ায় সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছি দুজনেই। এখন বন্ধন বলতে আমার কাছে রসায়নের আয়নিক, সমযোজী আর সন্নিবেশ বন্ধনই। যা-হোক, এই বিয়োগের ফলেই অবশ্য জীবনে অনেক কিছু যোগ হয়েছে। আমার পাহাড়ের সঙ্গে বনিবনা হয়েছে আরও পোক্ত।
গাড়িতে ফুর্বা অংডি, গেসমেন ছাড়াও আছে আমেরিকার নাগরিক ক্রিস। ক্রিস গড়নে ছোটোখাটো পাহাড়ের মতো দেখতে। প্রথম দেখায় বাস্কেটবল খেলোয়াড় বলে মনে হয়। গাড়ির সামনের সিটে বসতে গিয়েও ওর অতিকায় হাঁটু দুটোর স্থান সংকুলান না হওয়ায় ফিরে এসেছে পেছনের সিটে। ও গগনমার্গে ৩১ ঘণ্টা কাটিয়ে উড়ে এসেছে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস থেকে। জেটল্যাগ জনিত ক্লান্তি এখনো খানিকটা অসাড় করে রেখেছে ওকে।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই আমার চোখ দুটো বুজে যেতে শুরু করল। গত রাতের বকেয়া ঘুম থেকে চোখ দুটোকে বঞ্চিত করা উচিত না। কাঠমান্ডু থেকে বেসিশহরের পথের বেশিরভাগটুকু কাঠমান্ডু-পোখারা মহাসড়ক ধরে। দুমরে নামক জায়গা থেকে রাস্তা বেঁকে যায় অন্যদিকে। এই রাস্তায় অসংখ্য বাঁক। চোখ দুটো মুদে আসলেই ছিটকে পাশের জনের ওপর পড়ছি। রাস্তা দেখে অসংখ্য বাঁকের জন্য বিখ্যাত আমাদের দেশের ভৈরব আর কপোতাক্ষ নদের কথা মনে পড়ে গেল। অবশ্য সঙ্গী তানভীর ভাই এত দোলাদুলির মধ্যেও জড় পদার্থের মতো অসাড় হয়ে ঘুমাচ্ছে।
আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় প্রথম বিরতি। ফের উঠে বসতেই নেপালি উচ্চগ্রামের গানের যন্ত্রণা। তন্দ্রা অবস্থাতেই আরেকবারের বিরতিতে নেপালের কুমিল্লাতে জলভারমুক্ত হলাম একবার। দুমরের পর থেকে রীতিমতো গরম লাগতে শুরু করল। সোয়া একটা নাগাদ বেসিশহর পৌঁছে দুপুরের খাবারের বিরতি। এখানে আবার গাড়ি পাল্টাতে হবে। মাহিন্দ্রা বোলেরো ধরনের জিপ বাকি রাস্তার জন্য ভরসা। ক্রিস এক ফাঁকে জানতে চাইল রাস্তা কি এরপর আরও খারাপ হবে? আমি প্রত্যুত্তরে জানালাম, 'তুমি কেবল ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ এখনো দেখনি।' ভয় পেয়ে ও নিজের কোমর মালিশ করতে শুরু করল। 'রাস্তার দুর্দশা' যে আজকের গন্তব্য তিলচে অবধি আমাদের সঙ্গে বল্লমের মতো গেঁথে থাকবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
এবার পথ মার্শিয়াংদি নদীর পাড় ঘেঁষে। হাতের ডানে হিমবাহ গলা জলের নদীকে নিয়ে চলতে শুরু করলাম। ত্রিবেণী তোলের কাছে সেতু পেরিয়ে কিছুটা সময় নদীকে বামে নিয়ে চলা। অল্প এগিয়েই পড়ল একটা টানেল। আগেরবার এদিকটায় টানেলের নির্মাণকাজ দেখেছিলাম। এবার টানেলের পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম। দৈর্ঘ্যে যদিও খুব বেশি না এই টানেল। কিছুদূর এগিয়ে ফের নদীকে ডানে নিয়ে চলা শুরু। পুরো পথজুড়ে আমাদের সঙ্গে লেপ্টে থাকবে এই মার্শিয়াংদি নদী। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদীর জলধারার তর্জন-গর্জনের অন্ত নেই।
ওয়াটারফল নামে এক জায়গায় আবার বিরতি। খেয়াল করলাম আমাদের আরেকটা বোলেরোর চালক রবীন্দ্র গুরুং। আমাদের দুজনেরই পূর্ব পরিচিত। একবার ওর গাড়িতেই আমরা বেসিশহর ফিরেছিলাম। রবীন্দ্র ওর স্বভাবসুলভ ঢঙে আমাদের দেখেই বলে উঠল, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি'। এক দফা হাসিঠাট্টার পর আবার উঠে বসলাম। ততক্ষণে জাঁকিয়ে বৃষ্টি নেমে গেছে। দুধ সাদা নদীর জল মুহূর্তেই ঘোলা। সেদিক পানে তাকিয়ে তাকিয়ে চলা।
আমাদের বোলেরোতে এসে যুক্ত হয়েছে গেসমেন তামাং। নানান কথার ফাঁকে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলাম। 'লোয়ার সলোখুম্বু' উত্তর পেয়ে আমি কয়েকটা জনপদের নাম বলার পর ও জানাল ওর বাড়ি ফাপলুতে। ওদিকের বেশ কয়েকটা জনপদের নাম আমার মুখে শুনে ও বলল, 'ওদিকটা আমার এলাকা হলেও এতগুলো গ্রামের নাম আমিও জানি না'। কথায় কথায় বেরিয়ে এলো এভারেস্টে আমাদের হেড কুক পেম্বা ওর বোনের জামাই। এবার আমি জানালাম ওর বড়ো ভাই মিংমা আর ভাগনে ধর্মাকেও আমি চিনি। এবার ওর অবাক হবার পালা। 'আমার পুরো পরিবারকেই দেখি তুমি চেনো' ওর চোখে বিস্ময়।
যাত্রাপথে রাস্তার ওপরেই বেশ কয়েকটা বিশাল জলপ্রপাত। এর ওপর দিয়েই চলছে গাড়ি। অবশ্য আগেরবারের তুলনায় রাস্তা বেশ ভালো। ক্রিসকে সেই কথা বলতেই ও জানাল, 'এখন এই অবস্থা হলে আগের রাস্তা নিশ্চয় নরকযাত্রার সমতুল্য ছিল'। প্রত্যুত্তরে আমি জানালাম, 'যাত্রাপথ নরকতুল্য হলেও এই পথ স্বর্গের দিকেই গেছে।'
মার্শিয়াংদি নদীর ধারে তাল নামের সুন্দর ও ছড়ানো এক গ্রাম পেরিয়ে এক জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য থামানো হলো। পাহাড়ের ওপর থেকে ক্যাটারপিলারের সাহায্যে ভূমিধস ঘটাতে পারে এমন পাথর সরানো হচ্ছে। ক্যাটারপিলারের অবস্থান এত ওপরে যে আমাদের অবস্থান থেকে একে বাচ্চা ছেলের খেলনা বলে কল্পনা করাই সহজ। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ পৌঁছলাম তিলচে নামক গ্রামে। এখান থেকে এক ঘণ্টা হাঁটা দূরত্বে গোয়া যাবার পরিকল্পনা থাকলেও মেঘ-কুয়াশার চোখ রাঙানিতে আর এগোলাম না। মিনিট তিনেক হেঁটে পাগলা এক ঝিরির ওপরের সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে নামহীন এক লজে আস্তানা গাড়লাম।
তন্ময় জানিয়েছে আজ নাকি রেড মুন। ২২৬০ মিটার উচ্চতার এই অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রাম কি আজ জোছনায় ভিজবে? নাকি সন্ধ্যার দিকে নেমে আসা মেঘ-কুয়াশার পর্দার আড়ালেই থাকবে লালচক্ষু চাঁদ? ঘনিয়ে আসা রাতই দেবে এর উত্তর। আপাতত আশায় মরুক ব-দ্বীপ থেকে আসা দুই চাষা।


Comments