হাত নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকা সিনড্রোমের চিকিৎসা কী

হাত নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে কাজ করার নাম অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম। এটি এমন এক বিরল অবস্থা যেখানে হাত নিজের ইচ্ছার বাইরে কাজ করতে শুরু করে, হাতকে নিজের মনে না হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
কেন এ সিনড্রোম দেখা দেয়, না জানার কারণে অনেকেই ভীত হয়ে পড়েন। অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম সম্পর্কে জানিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চোধুরী।
এটা কি ডিসঅর্ডার?
অধ্যাপক জহিরুল হক চোধুরী বলেন, অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম (এএইচএস) হলো একটি বিরল নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডার যেখানে কোনো এক হাত (কখনো কখনো পা) রোগীর নিজের ইচ্ছার বাইরে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নড়াচড়া করে।
রোগী অনুভব করেন হাতটি যেন 'নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই' বা হাতটি তার নিজের নয়। এ কারণে অনেক সময় রোগী ভয়, বিভ্রান্তি বা মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। এর মূল কারণ হলো মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল, প্যারাইটাল লোব বা কর্পাস ক্যালোসামের ক্ষতি।
কেন হয়?
মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বিশেষ করে যেসব অংশ মুভমেন্ট কন্ট্রোল ও মস্তিষ্কের দুই পাশের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই সিনড্রোম দেখা দিতে পারে।
অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোমের সম্ভাব্য কারণ:
১. কর্পাস ক্যালোসাম: মস্তিষ্কের দুই পাশের সংযোগ নষ্ট হলে এক পাশ অন্য পাশের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
২. ফ্রন্টাল লোব ড্যামেজ: স্বেচ্ছায় কাজ করার পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. প্যারাইটাল লোব ড্যামেজ: স্পর্শ ও স্থানিক সচেতনতা কমে যায়, ফলে হাত অপ্রত্যাশিতভাবে নড়ে।
৪. স্ট্রোক: মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ব্যাহত হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে।
৫. ব্রেইন টিউমার: মস্তিষ্কের টিউমার দ্বারা চাপ সৃষ্টি, টিউমার কর্পাস ক্যালোসাম বা মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
৬. ট্রমাটিক ব্রেইন ইনজুরি: মাথায় আঘাতের কারণে এই সিনড্রোম দেখা দিতে পারে।
৭. নিউরোসার্জারি: মাথায় কোনো সার্জারি, বিশেষ করে কর্পাস ক্যালোসাম কেটে দেওয়া হলে, যেমন—এপিলেপসি অপারেশন হলে অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম দেখা দিতে পারে।
৮. নিউরো ডিজেনারেটিভ ডিজিজ: কর্টিকোব্যাসাল ডিজেনারেশন, আলঝেইমার রোগ ইত্যাদি হলে হতে পারে।
লক্ষণ
অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোমের লক্ষণগুলো একটু বিশেষ ধরনের। যেমন:
১. অপ্রত্যাশিত হাতের নড়াচড়া—কোনো বস্তুর দিকে হাত বাড়ানো, জামা খুলে ফেলা, চুল টানা, বা কিছু ফেলে দেওয়া।
২. নিজের বিপরীতে কাজ করা—এক হাত জামা পরাচ্ছে, অন্য হাত খুলে ফেলছে (একে বলে ইন্টারম্যানুয়াল কনফ্লিক্ট)
৩. হাতকে নিজের মনে না হওয়া—রোগী ভাবেন হাতটি যেন অন্য কারও অর্থাৎ 'অ্যালিয়েন'
৪. অসচেতনভাবে ধরা—হাত কিছু ধরে ফেলে এবং রোগী নিজে তা ছাড়াতে পারে না
৫. মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব—ভয়, উদ্বেগ, হতাশা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া
চিকিৎসা কী
অধ্যাপক জহিরুল হক চোধুরী বলেন, অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোমের স্থায়ী নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। মূলত থেরাপি, সাপোর্টভ ও রিহ্যাবিলিটেটিভ কেয়ার দেওয়া হয় রোগীকে। এছাড়া মূল রোগের চিকিৎসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
আচরণগত চিকিৎসা ও থেরাপি
১. হাতকে কোনো কাজে ব্যস্ত রাখা, যেমন—কাপড় ধরা, বল ধরা ইত্যাদি
২. হাতকে কোলে বসিয়ে রাখা বা অন্য হাত দিয়ে চেপে রাখা
৩. দৈনন্দিন কাজের জন্য অকুপেশনাল থেরাপি
ফিজিওথেরাপি ও কগনিটিভ থেরাপি
১. হাতের অস্বাভাবিক নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণের ব্যায়াম।
২. রোগীকে সচেতন করা যেন ভয়ের পরিবর্তে তিনি হাতকে সামলাতে শিখতে পারেন।
ওষুধ
কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে ওষুধ দেওয়া হয়, যেমন—বেনজোডায়াজেপিনস, এন্টি-এপিলেপটিক ড্রাগস বা বটুলিনাম টক্সিন ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়।
ওষুধের কার্যকারিতা সীমিত এবং রোগভেদে ভিন্ন হতে পারে।
মূল কারণের চিকিৎসা
১. স্ট্রোক হলে স্ট্রোক ম্যানেজমেন্ট।
২. টিউমার হলে অস্ত্রোপচার বা রেডিয়েশন।
৩. নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিজে সাপোর্টভ কেয়ার।
অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোমের লক্ষণ প্রকাশ পেলে উদ্বিগ্ন না হয়ে যত দ্রুত সম্ভব অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
Comments