শতবর্ষে লাইকা ক্যামেরা
ফটোগ্রাফির বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ম্যাগাজিন 'বেটার ফটোগ্রাফি'তে লাইকা ক্যামেরার ছবি ও ফিচার পড়ে লাইকা সম্পর্কে জেনেছিলাম। তারও অনেক পরে ভারতের বিখ্যাত স্পোর্টস ফটো জার্নালিস্ট বন্ধু প্রদীপ মানদানীর হাতে প্রথম দেখেছিলাম দৃষ্টিনন্দন লাইকা ক্যামেরা।
লাইকা ক্যামেরার ছবি যেন আর্ট বা পেইন্টিং! ভিনটেজ বা টোন অন্য কোনো ক্যামেরায় নেই, যা শুধুমাত্র লাইকাতে আছে। বিশ্বব্যাপী ফটোগ্রাফারদের স্বপ্নের ক্যামেরার নাম লাইকা।
লাক্সজারিয়াস লাইকা ক্যামেরা সাধারণত অভিজাত ফটোগ্রাফাররা ব্যবহার করেন। সাইজে সহজেই বহনযোগ্য এই স্বপ্নের লাইকা ক্যামেরা তার ১০০ বছর পূর্ণ করলো।
লাইকা ক্যামেরার প্রস্ততকারক একটি বিখ্যাত জার্মান কোম্পানি। ১৯২৫ সালে প্রথম ৩৫ মিমি ক্যামেরা লাইকা ১(এ) বাজারে আনে এবং ৩৫ মিমি ফিল্ম ফটোগ্রাফিকে জনপ্রিয় করে তোলে।
লাইকা ক্যামেরা তার উদ্ভাবনী ডিজাইন, ছোট আকার ও উচ্চ মানের লেন্সের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফটোগ্রাফি শিল্পে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এই ক্যামেরা, বিশেষ করে ফটো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে।
লাইকার বিভিন্ন মডেল তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে লাইকা ২—যেখানে প্রথম রেঞ্জফাইন্ডার ছিল—এবং বিভিন্ন মডেলের এসএলআর ও মিররলেস ক্যামেরা।
আমি লাইকা ব্যবহার করবো—এমন চিন্তাও আসেনি কোনো কালে! দামের কথা ভেবেই প্রিয় লাইকা থেকে দূরে ছিলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী লেন্স এই লাইকার। বছর সাতেক আগে এক বন্ধুর হাতে লাইকা দেখে একটু ছুঁয়ে দেখলাম, ছবি তুললাম এবং মুগ্ধ হলাম। বেশ কিছুদিন ব্যবহার করলাম আরেক বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে!
প্রথম প্রেমে পড়ার মতো আমি লাইকার প্রেমে পড়ে যাই। বিয়ের ছবি এক সময় আমি নিয়মিতই করতাম। ক্যামেরার ব্যাগের এক কোনে লাইকার এম ২৪০ ক্যমেরাটা থাকতো, বর-কনের কিছু ছবি তুলতাম লাইকা দিয়ে। ইভেন্ট শেষে বাড়ি ফিরে যারপরনাই মুগ্ধ হতাম ছোট্ট লাইকার বিশাল ফলাফল দেখে। সেই ছবি যেন আমার সঙ্গে কথা বলছে!
ক্যামেরাটি খুবই ছোট। সহজেই হাতে রাখা যায়। অসাধারণ বিল্ড কোয়ালিটি, চমৎকার লেন্স এবং একটি ক্লাসিক ডিজাইন বলেই হয়তো এতো জনপ্রিয় লাইকা। নান্দনিক ডিজাইনের সঙ্গে লাইকার নির্মাণ শৈলীও মুগ্ধ করে।
আলোকচিত্রী সাঈদ সিদ্দিকী—যাকে আমরা রুমি নামে চিনি—আলো-ছায়ার অসাধারণ পোট্রেট ছবি তোলেন। পৃথিবীতে এমন কোনো ক্যামেরা নেই, তিনি ব্যবহার করেননি বা তার কাছে নেই।
রুমি ভাইয়ের সঙ্গে লাইকা নিয়ে আলাপ করতেই একটু নড়েচড়ে বসলেন। তিনটি লাইকা ব্যবহার করেন তিনি—মোনোক্রোম, এম ৮ ও এম ১০। তার মধ্যে মোনোক্রোমে মুগ্ধ রুমি ভাই। সাদাকালোর এই ক্যামেরা রুমি ভাইকে সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চিত করে।
ফটোগ্রাফি তার প্রথম নেশা। এই নেশাতেই নিত্য নতুন ক্যামেরা কেনেন। হাসতে হাসতে রুমি ভাই বললেন, 'জন্মদিন এলে আমার প্রিয় সহধর্মিণী আমাকে নতুন লাইকা উপহার দেন।'
রুমি ভাই জানালেন, লাইকা ক্যামেরার বডির চেয়ে লেন্সের ভ্যালু বেশি। লাইকার লেন্সের মধ্যে ৫০ এফ-২ তার প্রিয় লেন্স।
১০০ বছর পর ২০২৫ সালে এসে লাইকা শুধু একটি নাম নয়, আজও আধুনিক আলোকচিত্রে অগ্রণী। শতবর্ষ মানে শুধুই অতীত উদযাপন নয়, বরং আগামী দিনের স্বপ্নও বটে। লাইকার এই যাত্রা প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি বদলালেও শিল্প আর সত্যের অনুসন্ধান কখনো বদলায় না।
লাইকার প্রেমের কথা ব্যক্ত করলেই লাইকা এম-২৪০ ব্যবহারকারী ইয়াং ট্যালেন্ট ফটোগ্রাফার মুনতাসির মঈন বলেন, 'লাইকাতে ছবি তোলা ছবি আঁকার মতো একটা ব্যাপার। সব ম্যানুয়ালি করতে হয়, ছবি আঁকার মতো আগে চিন্তা করতে হয়—ফোকাস ঠিক হলো কিনা, শাটার কত, আইএসও কত, আরও কত কি। অন্য ক্যামেরার মতো অটো অপশন না থাকায় এভাবে চিন্তা করতে বাধ্য। মোটামুটি চিন্তার একটা খোরাক। আমার এটা ভালো লাগে।'
আরও বলেন, 'এর ভিনটেজ টোন অন্য ক্যামেরাতে নেই। ছবি দেখলেই বোঝা যায়, এটা লাইকার ছবি। আবার আমার কাছে এরচেয়ে সুন্দর ক্যামেরা আর পৃথিবীতে নেই। এত সুন্দর মিনিমালাস্টিক ডিজাইন। লেন্সগুলো খুব হ্যান্ডি।' গুণি আলোকচিত্রী মুনতাসির মঈন।
লাইকা ব্যবহারকারী আরেক ফটোগ্রাফার হাসিনুর রেজা মনে করেন, লাইকার কালার রেন্ডারিং আর কন্ট্রাস্ট অসাধারণ। লাইকা ক্যামেরাগুলো তীক্ষ্ণতা ও চমৎকার রঙের জন্য পরিচিত। এর একটি ক্লাসিক ডিজাইন রয়েছে, যা অনেক ফটোগ্রাফারের কাছে আকর্ষণীয়।
ফটোগ্রাফারদের আস্থা বজায় রেখে লাইকার এই দীর্ঘ পথচলা। ১৯২৫ সালে লাইকা যখন ক্যামেরা বাজারজাত করে, তখনকার দিনে ফটোগ্রাফিতে অনেকটা বিপ্লব এনে দেয়। কারণ, বড় ক্যামেরা না নিয়ে ছোট একটা ক্যামেরায় অসাধারণ ছবি তোলা যেতো।
লাইকার লেন্স দিয়ে ছবি তুললে একটি থ্রিডি লুক পাওয়া যায়, হাতে নিলে মনে হয় এক টুকরো ধাতব শিল্পকর্ম। আলোকচিত্রের ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আছে যেগুলো সবকিছু বদলে দেয়। লাইকার আবিষ্কার শুধু একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছিল না, বরং একটি দার্শনিক পরিবর্তন। অনেকের কাছে লাইকা শুধু যন্ত্র নয়, বরং একটি জীবনধারা।
১০০ বছর পর ২০২৫ সালে এসে লাইকা শুধু একটি নাম নয়, আজও আধুনিক আলোকচিত্রে অগ্রণী। শতবর্ষ মানে শুধুই অতীত উদযাপন নয়, বরং আগামী দিনের স্বপ্নও বটে। লাইকার এই যাত্রা প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি বদলালেও শিল্প আর সত্যের অনুসন্ধান কখনো বদলায় না।
শতবর্ষ পূর্তির এই বিশেষ মুহূর্তে লাইকা পরিবারকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী প্রজন্মও লাইকার হাত ধরে নতুন আলোতে পৃথিবীকে দেখবে, দেখাবে।
আলোকচিত্রী ও পরিচালক, ফটোগ্রাফি চর্চা


Comments