রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগার

বিনষ্টের ঝুঁকিতে ২ লাখ বইয়ের সংগ্রহ

দেশে উচ্চশিক্ষার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠগুলোর একটি রাজশাহী কলেজ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি বছরের র‍্যাঙ্কিংয়েও রয়েছে ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলজের নাম। এই কলেজের গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে ২ লাখের বেশি দুর্লভ বই। দেড়শ বছরের পুরনো লাইব্রেরিজুড়ে অসংখ্য মূল্যবান বই নষ্ট হতে চলেছে। হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষার দুর্ল্ভ প্রামাণ্য সংগ্রহ।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী কলেজে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অসংখ্যা কীর্তিমানের স্মৃতি রয়েছে। ১৮৭৩ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে লাইব্রেরি তার কার্যক্রম শুরু করেছিল কি না- সে বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকলেও বইপত্র দেখে বলা যায় লাইব্রেরি কার্যক্রম শুরু থেকেই ছিল। তাছাড়া ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হতে হলে অন্যতম শর্ত হিসেবে একটি ভালোমানের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। সে ধারায় ১৯১০ সালে কলেজের কমনরুম ভবনের ছোট ৩টি কক্ষ নিয়ে লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯০৮-১৯১২ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিদর্শকবৃন্দ এসে লাইব্রেরির অবস্থান ও পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ এনে আরও আন্তরিক হতে বলেন। তারপরই আসে নতুন গতি। 

ধীরে ধীরে সংগ্রহ বাড়তে থাকে। ১৯২০ সালের মধ্যে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ২৭৫টি। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত লাইব্রেরির বই ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল বার্ষিক ৪ হাজার টাকা। বই বাঁধাইয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ২০০ টাকা। সে সময় লাইব্রেরিটিতে প্রায় ৭৮ হাজারের মতো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, পুঁথি ও সাময়িকী ছিল। 

লাইব্রেরিয়ান মহিউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বর্তমানে লাইব্রেরিতে বই আছে ২ লাখের উপরে। তার মধ্যে ৫০ হাজার আছে দুর্লভ বই। ১০০-এর অধিক পত্রিকা ও জার্নাল রয়েছে। ১০০ বছরের পুরনো পাণ্ডুলিপি, ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া-এর ৪৫টি খণ্ড রয়েছে। ২০০ বছরের পুরনো পুঁথি রয়েছে। বাংলার পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয়, ব্রিটিশ আমলের ইংরেজি বইসমূহ বেশ যত্ন করে রাখা আছে।

অধিকাংশই পুরনো ও মলাট ছেঁড়া বই রাখা সারি সারি আলমিরা। ছবি : দ্য ডেইলি স্টার।

পুঁথি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুঁথিগুলো তুলোট কাগজে লেখা। পুঁথির কাগজ হরিতাল, অভ্র ইত্যাদির প্রলেপ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা আছে। হরীতকী, হিঙ্গুল, অঙ্গার, ছাগদুগ্ধ, জবার কুড়ির সাহায্যে তৈরি কালিতে লেখা।  শূর, ময়ূর বা শকুনের পালক দিয়ে তৈরি কলমে লেখা, কালির রঙ ঘন কালো। সংস্কৃত সাহিত্যের বেদ, পুরাণ, মহাকাব্য, কাব্য, তন্ত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পুঁথিগুলো লেখা। এই পুঁথিগুলো দেশীয় উপকরণে প্রস্তুত। পুঁথিতে এই অঞ্চলের সামাজিক ও পারিবারিক বিষয় উল্লেখ আছে সংস্কৃত ভাষায়। এগুলো সেলাইবিহীন কাঠে পাটাতনে বাঁধা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লাইব্রেরিতে ঢুকতেই সামনে চোখে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। একাডেমিক বই পড়ার অংশ ছাড়া দ্বিতীয় অংশে আবদ্ধ জরাজীর্ণ রুম। লেখা আছে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবেশ নিষেধ। আলমিরা ও বইয়ে ধুলোর স্তূপ। অধিকাংশই পুরনো ও মলাট ছেঁড়া বই। মাকড়সার জালে ছেয়ে আছে এদিক-ওদিক। বসার বা হাটার কোনো পরিবেশ নেই। অনেক শিক্ষার্থী জানেনই না তাদের প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে কত পুরনো বই আছে। আলমারির ধুলোর আস্তরণ দেখে বোঝা যায়, অনেকদিন এগুলো খোলা হয়নি।

একাডেমিক বই পড়ার অংশ ছাড়া দ্বিতীয় অংশে আবদ্ধ জরাজীর্ণ রুম। লেখা আছে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবেশ নিষেধ। ছবি : দ্য ডেইলি স্টার।

কথা হয় রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মাহাবুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে নিজের বই পড়ার পর পুরনো গবেষণার বইপত্র দেখা ও পড়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমরা পুরনো বইয়ের দিকে কখনো যাইনি। তবে অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা চার দেয়ালের বাইরেও পড়তে চান। তাদের জন্য এই লাইব্রেরি অনেক সহায়ক।'

কলেজের আরেক শিক্ষার্থী আজমিন আক্তার ইভা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আমি মাঝে মধ্যে লাইব্রেরিতে যাই। সাধারণত শিক্ষার্থীরা সব জায়গায় যেতে পারে না। আমি অনুমতি নিয়ে দুর্লভ বই যেখানে আছে তা দেখে এসেছি একদিন। খুব ভালো লেগেছে। বইগুলোর আরও যত্ন দরকার, দরকার সংরক্ষণ। না হলে হারিয়ে যাবে দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ।

এ প্রসঙ্গে লাইব্রেরিয়ান মহিউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিছু বইয়ে ধুলাবালি জমে আছে কিন্তু আমরা চেষ্টা করি পরিষ্কার রাখতে। বইগুলো ডিজিটাল রাখার বিষয় বরাদ্ধের যেমন সংকট তেমনি আছে বিধিনিষেধ। কোন বই পিডিএফ করা যাবে, কোনটা যাবে না তা নিয়ে আলোচনা থাকে। এর মধ্যেও বিভিন্ন জায়গা থেকে গবেষকরা আসেন, কাজ করেন। করোনার আগে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৪০০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী লাইব্রেরিতে আসতেন। এখন তা কমে ১০০-২০০ জনে দাঁড়িয়েছে। তবে লাইব্রেরিতে  আধুনিক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা স্থাপনের মাধ্যমে লাইব্রেরিটি তথ্যবিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।'

বই নষ্ট হবার বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের কলেজের মতো লাইব্রেরিরও অনেক সুনাম। কিন্তু আমাদের লাইব্রেরিতে জায়গা বইয়ের তুলনায় কম। পুরনো বইয়ের জন্য যে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও স্থান দরকার তা আমাদের নেই। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি হিসেবে এর গুরুত্ব বিবেচনায় আলাদা জায়গা দরকার যা আমাদের নেই। পুরনো বইগুলো নিয়ে নানান উদ্যোগ নিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নতুন বই কিনতে উৎসাহিত করে কিন্তু পুরনো বই নিয়ে কোনো বরাদ্ধ বা আগ্রহ নেই। ফলে দুর্লভ বইগুলো নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

পুরনো বই সংরক্ষণ প্রসঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, দুর্লভ বই সংরক্ষণ নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই ভাবছে। সে জন্য গত দুই মাস আগে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তারা বিশেষ করে শতবর্ষী কলেজের দুর্লভ ও গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের সংরক্ষণ ও পিডিএফ নিয়ে কাজ করবে।' গত দুইমাসে কমিটি কী করেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তাৎক্ষণিক বলা সম্ভব না, খুঁজ নিয়ে জানানো যাবে' 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও গবেষক অনিক মাহমুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম। লাইব্রেরির সঙ্গে অনেক স্মৃতি আমার। এই অঞ্চলে অনেক আগ থেকেই সমৃদ্ধ লাইব্রেরি এটি। উনবিংশ শতাব্দীর বহু প্রাচীন ও দুর্লভ বই-পত্র রয়েছে। বিশেষ করে বেঙ্গল গেজেটের অনেক সংখ্যা আছে। আছে কলকাতা ও বরেন্দ্র অঞ্চলের নথিপত্র এবং তালপাতার পুঁথি। যেগুলোতে পাওয়া যাবে সমাজ সংস্কৃতির চিত্র। বইগুলো রক্ষা করা জরুরি।'

রাজশাহী মুসলিম ক্লাবের উদ্যোগে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজশাহী কলেজেও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন। ছবিটি তোলা হয়েছে সাহেব বাজারে। ছবি: সংগৃহীত

এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'রাজশাহী কলেজে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন। সময়টা ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাস। ফুলার হোস্টেলে রাজশাহী কলেজের মুসলমান ছাত্ররা কবির সম্মানে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ টি টি উইলিয়ামস ও অধ্যাপক শেখ শরফুদ্দিনও ওই ভোজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কবি এখানে বক্তব্য দেন ও সংগীত পরিবেশন করেন। রাজশাহী মুসলিম ক্লাবের এই উদ্যোগে তার সফরসঙ্গী ছিলেন কবি শাহাদাৎ হোসেন ও কবি বন্দে আলী মিয়া। বকুলতলায় কবির সঙ্গে শিক্ষার্থীরা দলগত ছবিও তোলেন। সে হিসেবে জাতীয় কবির স্মৃতি রয়েছে এই প্রাঙ্গনে।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

3h ago