উৎসব ঘিরে লেখক তৈরি কতটা ভালো

বই মানুষকে মানুষ হতে শেখায়। সমাজে অন্ধকার দূর করে আলোসম্পাত এনে দেয়। বইয়ের গুরুত্ব তাই অনিবার্য। দীর্ঘ সংগ্রাম লড়াইয়ের পর বাঙালির চেতনায় বইমেলার স্বতন্ত্র গুরুত্ব লক্ষণীয়। প্রতিবছর অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে বইমেলার আয়োজন হয়ে থাকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ও রমজান মাস উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন হবে এ বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। তার মানে এক বছরে দুটি মেলাং মেলার এ কাল নিয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠেছে। একই বছর দুবার মেলার আয়োজন কীভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। এই বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গতকাল।
ভাষা-আন্দোলনে বাঙালি জাতির এক অপূর্ব অর্জন বাংলা ভাষাকে বিশ্বে দরবারে পরিচিতি করে তোলা। বাংলা ভাষা গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কার্যক্রম হলো বইমেলা।
মেলার প্রারম্ভ কাল থেকে বর্তমান অবধি নির্ধারিত দিনক্ষণে বইমেলা আয়োজিত হলেও ছেদ পড়েছে কখনও কখনও। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দেই এই মেলার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলনরত দুই শিক্ষীর্থী নিহতের ঘটনায় তা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ২০২১ খ্রিস্টাব্দে করোনা মহামারির সময় বইমেলা মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পনের দিনের এ মেলায় প্রকাশক ও লেখকদের বেশ ক্ষতি গুনতে হয়েছে। অনেক প্রকাশক এ মেলায় অংশগ্রহণ করেননি। প্রাণহীন মেলায় প্রাণের স্পন্দন সামান্যই লক্ষ করা গেছে। ২০২২ সালে করোনা আতঙ্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মেলার স্থিতিকাল ছিল ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত। ২০২৫ সালে ভিন্ন আবহে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টে স্বৈরাচার সরকার পতনের পর মেলার প্রত্যাশিত পরিবর্তন এসেছিল। ২০২৫ এর বইমেলার প্রতিপাদ্য ছিল 'জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ'। বৈষম্যহীন সমাজগঠনের বৈষম্যবিরোধী বিভিন্ন বই মেলায় পাঠকদের নজর কেড়েছিল।
আগামী মেলাকে কেন্দ্র করে নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। বছরে দুটি মেলার আয়োজনে প্রকাশক- লেখকদের প্রস্তুতি নেই। পাঠকরাও এই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বই কিনতে আগ্রহী হবেন কি-না তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। একটি মেলা শেণ হওয়ার পর প্রকাশকেরা আরেকটি মেলার পরিকল্পনা করেন। তাতে কিছুু সময়ও তাঁরা পান। লেখকদেরকে পাণ্ডুলিপি জমা দেয়ার জন্য একটি সময় বেঁধে দেন। লেখকও অনুরূপ প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু এবারের বইমেলার তারিখ ঘোষণার পর বিপাকে পড়েছেন উভয় পক্ষই। অন্যদিকে রয়েছে পাঠকদের মানোজগত। পাঠকেরাও প্রতিবছর একুশে গ্রন্থমেলাায় চাহিদামত বই ক্রয় করে থাকেন।
একুশের আবহের সঙ্গে বইমেলা যেন বাঙালি সংস্কৃতির একই সুঁতোয় বোনা। প্রকাশক, লেখক, বইপ্রেমিদের এক আনন্দ নিলয়ে পরিণত হয় মেলা প্রাঙ্গন। পাঠকদের বইক্রয়ের মানসিকতার সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতার সামর্থ্যকেও গুরুত্ব দিতে হয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস মধ্যবিত্ত জীবন। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর বাস্তবতায় বই কেনার সাদ থাকলেও সাধ্য কতজনের থাকবে সে বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে আসন্ন বইমেলায়। নতুন প্রকাশকগণ বইমেলা কেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। উঠতি প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে নতুন প্রকাশকগণ বইমেলায় ভালো পরিচিতি লাভ করেন। সময় ও সুযোগ কম থাকায় এবার তাঁদের সেই সুযোগ হাত ছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় পড়তে হবে।
ফ্রেব্রুয়ারি ভাষার মাস বিধায় নানা ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা মেলায় এসে হরেক রকম বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং চাহিদামত বই ক্রয় করে থাকে। বাঙালির চেতনার জাগ্রত প্রতীক হলো শহীদ মিনার। প্রভাত ফেরিতে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় মানুষের আগমন ঘটে। মেলাকে উদ্দেশ করেই তাদের আসা। মেলা থেকে বই কেনা ও প্রিয়জনকে উপহার দেয়া আমাদের রীতিতে পরিণত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ব্যতীত অন্য মাসে বইমেলা হলে আমেজ বিনষ্ট নয়। এবারের অনুষ্ঠেয় মেলায় এ ধরনের নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
আর্থ-সঙ্কটের কারণে অনেক প্রকাশক এবারের বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। একই বছরে দুবার লোকসান গোনার মত হয়তো অর্থ নেই। সৃজনীশক্তিধর লেখকেরা আবেগ-ভালোবাসা থেকে প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে থাকেন। গ্রন্থ বিক্রি যৎসামান্য হয়। তাতে সংসার চলে না। কর্মচারীদেরও বেতন জোটে না। বইপ্রেমিক এসব লেখকদের সরকারি কোনো প্রণোদনাও নেই। সংসার-পরিবার অনেককেই এ কাজে সহায়তা করতে অনাগ্রহী। এসব প্রকাশকেরা এবার বিপাকে পড়বেন।
বইমেলার উপর্যুক্ত বিতর্কের বিপরীত ভাবনাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকে মনে করেন, বইমেলা একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয় বটে কিন্তু এটিই তো চূড়ান্ত নয়। সরকার চাইলে তা পরিবর্তন করতে পারেন। এবারের বিষয়টা ভিন্ন বলে তা সবাইকে মেনে নিতেই হবে। জাতীয় স্বার্থ। জনগণের জন্য নির্বাচিত সরকারের আয়োজনে জনমানুষের সমর্থন থাকতে হবে। যদিও একটু কষ্টের বিষয় তবুও বৃহত্তর স্বার্থে মেনে নেয়া জরুরি। ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখে মেলা। এখনও প্রস্তুতি নেওয়ার সময় কম নয়।
লেখক-প্রকাশক মনোযোগী হলেই সম্ভব। বই প্রকাশ ও বই লেখা চলমান প্রক্রিয়া। কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণে লেখক লেখেন না। এটি তাদের সঞ্জীবনী শক্তির প্রকাশ। লেখককে সময়ে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেললে তাঁর সৃজনশীলতা ক্ষুন্ন হওেয়াটা স্বাভাবিক। এমনও দেখা গেছে প্রকাশকদের অনুরোধের টোপে লেখকের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বই লেখাই যেন তাঁর দায়। মান ঠিক থাকলো কি-না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এমন পরিস্থিতিও বর্জনীয়।
বইমেলা কেন্দ্রিক লেখক তৈরি হওয়াটাও শুভ লক্ষণ নয়। বিগত বছরগুলোতে নতুন লেখকের আবির্ভাব হতে দেখা গেছে। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে বই কিনেছেন। রাজনৈতিক নেতা, কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, সরকারি চাকুরিজীবী কিংবা বড় ব্যবসায়ী এসব গ্রন্থের প্রণেতা। লেখার জগতে এসব ব্যক্তিবর্গের আগমন অযাচিত নয়, নিষেধও নয়। কিন্তু মানহীন গ্রন্থ প্রকাশ করে অনুসারী ও অধস্তনদের বই কিনতে বাধ্য করা অপরাধ। এসব লেখক ও প্রকাশকদের জন্য বইমেলার নির্ধারিত সময়ের পরিবর্তনে বিরূপ মনোভাব পোষণ-বিবেচ্য নয়। এক সময় মেলা থাকবে না, সে সময় নিয়ে ভাবছি আমরা? কীভাবে বই পাবে আমাদের পাঠক?
মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিকে আরও সোচ্চার হতে হবে। মান রক্ষার জন্য একটি দক্ষ কমিটি গঠিত হতে পারে। তাদের অনুমতি সাপেক্ষে বইমেলার প্রকাশকেরা বই প্রদর্শন ও বিক্রি করতে পারবেন। সংখ্যাকে প্রাধান্য না দিয়ে গুণগত দিকের প্রতিই মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করি।
বাংলাদেশে প্রকাশক-লেখকদের মধ্যকার চুক্তিও লঙ্ঘিত হয়। লেখকের পাওনা টাকা দেন না অনেক প্রকাশক। কতটি বই ছাপেন, কতটা বই বিক্রি হলো তার হিসেব লেখককে জানান না প্রকাশকেরা। প্রতিবছর বইমেলায় স্টল বরাদ্দের সময় বাংলা একাডেমির নিয়মানুযায়ী লেখক-প্রকাশকের চুক্তি সংক্রান্ত একটি ফর্দ পূরণ করে জমা দিতে হয়। কাগজে-কলমে তা জমা দেয়া হয়। বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।
ফলে অনেক লেখকই তাদের প্রাপ্য অর্থ পান না। আবার মৃত লেখকের বই বিভিন্ন প্রকাশক ছাপেন ও বিক্রি করেন। তার অর্থ সংক্রান্ত চুক্তি পরিবারের সঙ্গে থাকে না। প্রকাশনা জগতে এরূপ অনেক অসামঞ্জস্য বিষয় রয়েছে। কেবল গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করেই যে এ ধরনের চুক্তি ও নিয়ম মানা হবে তা নয়। বছর জুড়েই এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। গ্রন্থ লেখক স্বত্বের বিষয়ের ব্যাপারে সরকারকে যুগোপযুগী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রকাশক ও বইবিক্রেতাগণ নামি দামি লেখকের বই পাইরেসি করে থাকে। তারা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই চক্র লেখকের মেধাস্বত্বকে ব্যবহার করছে কিন্তু বিনিময়ে কোনো অর্থ দিচ্ছে না। এ বিষয়টিও জরুরিভাবে দমন করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশের প্রকাশকেরা প্রতিবছর মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। হাতে গোনা প্রকাশনা বছরে দুএকটি বইমেলা করলেও অধিকাংশের এ বিষয়ে কোনো চিন্তা নেই। একসময় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে নিয়মিত আয়োজিত হতো আন্তর্জাতিক বইমেলা। সে উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে। অথচ বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতির জন্য এর গুরুত্ব অনেক। সরকারের সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারে।
বইমেলা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রকাশে ও বিকাশে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বছরে দুটি বইমেলার এবারের আয়োজন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা। এটি মেনে নিয়েই প্রকাশক-লেখকদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা জরুরি। মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিকে আরও সোচ্চার হতে হবে। মান রক্ষার জন্য একটি দক্ষ কমিটি গঠিত হতে পারে। তাদের অনুমতি সাপেক্ষে বইমেলার প্রকাশকেরা বই প্রদর্শন ও বিক্রি করতে পারবেন। সংখ্যাকে প্রাধান্য না দিয়ে গুণগত দিকের প্রতিই মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করি।
Comments