স্থান ও কালোত্তীর্ণ কবি ওমর আলী

শতাব্দিতে এমন ব্যক্তি দু-একজন আসেন সমাজে, যারা প্রান্তে থেকেও মানুষকে নতুন পৃথিবীর পথে ধীর পায়ে হাঁটান। তেমনই একজন কবি ওমর আলী।
'এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি' খ্যাত কবি ওমর আলীর জন্মদিন আজ। পাবনায় জন্ম নেওয়া এই কবি তার বিশ্বকে আমাদের জানা বিশ্বের ভেতর নিয়ে নান্দনিকভাবে ভেঙে আলো আর অন্ধকারের বিচিত্র বর্ণ হাজির করেন!
কিন্তু আমাদের জ্ঞাত জগত কি কবির হৃদয়-বিশ্বের সমগ্র ছবিকে ধারণ করতে পারবে? আমাদের ভুল প্রেম, ভুল ভালোবাসা, ভুল রাজনীতি, ভুল সমাজ জীবন কবির হৃদয় আয়নায় ক্রমাগত উন্মুক্ত হবে? নাকি এক বৃষ্টিস্নাত গ্রামের মেঠোপথ ধরে ঘুরতে ঘুরতে আমরাও হারিয়ে যাবো কবির অচীন দেশে!
শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজের সিঁড়ি বেঁয়ে শরীর দুলিয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে হেঁটে কোমরপুর চলে যাবো, যেখানে কবির ছিন্নবস্ত্র, লেখার খাতা, লেখার কলম, কবির গ্রাম্য বউ পড়ে থাকেন। ওখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চেয়ারম্যানের মোড় পার হয়ে চলে যাবো প্রমত্তা পদ্মার কাছে, যে পদ্মায় ভেসে ভেসে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যে পদ্মার ওপারেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই পদ্মার পারে গিয়ে কি দেখবো—ওই, ওই তো ওমর আলী হেঁটে যাচ্ছেন... ওই তো ওমর আলী আকাশ দেখছেন, পাখি দেখছেন?
ওমর আলী বুলবুল কলেজের সামনে একটি জীর্ণ কক্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পড়াতেন। পড়ানোর চাইতে তিনি বেশিক্ষণ কবিতায় লীন হয়ে থাকতেন। আমরা কি ওই কক্ষ ভেঙে ভেঙে দেখবো, কবির পায়ে মাখা ধূলো আজ কোথায় গেলো? এই ইট-কাঁঠ, এই ধূলো-বালি, এই মেঠো পথ, পিচ ঢালা সড়কের কোথায় কবি? কোথায় কবির ছায়া ও ঘ্রাণ—এই আকাশ ও মাটি কি উত্তর দেবে আমাদের?
একদিন শহরের প্রায়ান্ধকার গলি দিয়ে হাঁটছি কবি আখতার জামান ও সমীর আহমেদের সঙ্গে। হাঁটতে হাঁটতে যখন বোধের বর্ণিল নদীর তীরে, তখন আখতার জামান বলে উঠলেন, 'ওমর আলী একুশে পদক পাবেন, আজ হোক আর কাল!' সমীর আহমেদ বলে উঠলেন, 'আর বলো না, এরা কি যে করে! সব শুধু ধানাইপানাই!'
আলোচনায় আমি অর্বাচীন শ্রোতা। দুজনই আমার শিক্ষক। পথ চলতে চলতে দুয়েকটা উদ্ভট প্রশ্ন করি তাদের। আমার প্রশ্ন হলো, 'ওমর আলী কে?' বড় বিচিত্র সে কণ্ঠ আমার। আখতার জামান বিস্মিত হলেন। বললেন, 'তুমি কবি ওমর আলীকে চেনো না?' আস্তে আস্তে মাথা নাড়ালাম।
অতঃপর কবির পরিচয় পেলাম—এক ধূলোমাখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষের আয়ুআলো নিয়ে আমাদের ভূ-খণ্ডের বায়ু-জলে ভেজা মাটির গন্ধ নিয়ে গ্রামীণ বৌয়ের সৌন্দর্য্যে বিভোর মানুষ।
কবি জানাচ্ছেন— কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে, সাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা
টিএস এলিয়ট, মালার্মে, রবীন্দ্রনাথ, ওমর আলীর হাতের ওপরে কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে
আমাদের চিত্তে দোলা লাগে, ঝর ঝর করে ঝরে পড়া কবিতা হয়ে ওঠে রাতভর শিশিরে সিক্ত হওয়া ভোরের শিউলির মতো। ভেজা শেফালির মতো ঝরতে ঝরতে কবিতা নেমে আসে আমাদের শিল্পিত মনশ্চক্ষে। চোখ বন্ধ করে ভেজা শেফালি ও ঝরতে থাকা শিউলির ভেতর দিয়ে আমরা কবিতায় প্রবেশ করি—
কবিতা মনের মধ্যে এক খণ্ড সীমানা চৌহদ্দির জমির ওপরে
ঝরে যায় বহুক্ষণ ঝরে যায় বৃষ্টি
ওপরে মেঘ বিজলির চমক বজ্রপাত হতে থাকে
আমরা এগোতে থাকি কবির দিকে, কবির পথে... এগিয়ে যাই। দেখি, কবি গাইছেন—
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে শিশির মুক্তা হোমারের মনের ওপর
অন্ধ হোমার গেয়ে যান ইলিয়াড ও ওডিসি
সুন্দরী হেলেনকে নিয়ে যান প্যারিস প্রিয়ামের পুত্র
কবি হাঁটছেন সহস্র বছরের প্রাচীন পথ ধরে প্রাচ্যের বেতসা ছাড়িয়ে প্রতীচ্যের ট্রয়ে। চোখের পর্দা নামিয়ে শ্যামল রঙের রমনীকে পাশে রেখে সুন্দরী হেলেনের কাছে। পরিণতিতে সভ্যতার কাঠকে ডিঙিয়ে মারা যান বীর হেক্টর-অ্যাকিলিস।
কবি তার সময়ের অনুবাদক, সময়ের নিবিড়তম ইতিহাসকার। সময়ের ভেতর দিয়ে কবি জেগে ওঠেন আপন সত্তায়, আপন মহিমায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে। আর কবিতার ভেতর দিয়েই বুনে বুনে যান সময়ের ঘটনাপুঞ্জ, কবিতা হয়ে ওঠে সময়ের শাশ্বতলিপি।
বিচলিত হয় আমাদের হৃদয়। মৃত্যু মানে বিচ্ছিন্নতার আশংকায় বিহ্বল হই। অতঃপর দেখি কবি আমাদের জানাচ্ছেন, মৃত্যু এক অমোঘ নিয়ম। কে না মারা যায়! কে না নিঃশেষিত হয়! পৃথিবীর আয়ুর সমান এই চলে যাওয়া—
পৃথিবী কোটি কোটি বছর ঘুরতে থাকে নিয়ম মতো
এক মুহূর্তের জন্যও থামে না।
এবং দেখি, মানুষের মতোই কবি স্যাফো, খলিল জিবরান জন্ম নিচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন। বুঝি কবিও যাবেন, কবিরাও যাবেন। আমরা এই জন্ম ও মৃত্যুর খেলার মাঠে খেলতে থাকি এবং খেলতে থাকে মানুষ, খেলতে থাকবে মানুষ।
কবি তার সময়ের অনুবাদক, সময়ের নিবিড়তম ইতিহাসকার। সময়ের ভেতর দিয়ে কবি জেগে ওঠেন আপন সত্তায়, আপন মহিমায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে। আর কবিতার ভেতর দিয়েই বুনে বুনে যান সময়ের ঘটনাপুঞ্জ, কবিতা হয়ে ওঠে সময়ের শাশ্বতলিপি।
এই সময় আসলে কী? সময়ের শুরু ও পরিণতি কেমনতর ধারণা? সময়ই কি শেষ হয়, নাকি অস্তিত্বের বিনাশ হয়? আমরা যখন এসব প্রশ্নের অবতারণা করছি, ঠিক তখনই সেসব প্রশ্নকে অতীতে প্রেরণ করছি এবং আমাদের সেই সময়ের অস্তিত্বকে অতীতে রেখে দিচ্ছি। আমাদের জ্ঞাত জ্ঞান-জগতের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণপ্রাণ কবি নিরন্তর জিজ্ঞাসার সেই সময়কে দেখছেন—
সময় তো চলে যায়, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন
শেষ হয় তীরে গিয়ে, জীবন ফুরিয়ে যায় ঠিক
এখনি যখন প্রতি মুহূর্তের অতীতে গমন;
আমাদের 'এই আছি' ধারণাকে প্রতিনিয়ত পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকা ধারণা নতুন নতুন স্মৃতি সৃষ্টিতে মেতে রয়। কবির গীত—
নতুন মুহূর্ত ফের জন্ম নেয়, সুখের দিকে
যায় যেন মরণের দিকে কোনো নতুন অতীতে।
সময়ের উত্তাল পথে। আমাদের চেতন নির্মাণ-বিনির্মাণের পরিক্রমায় এগোয়—
যেমন একটি ফের সূর্যোদয় থেকে ক্রমাগত
সন্ধ্যার চরম কোণে যেতে থাকে মৃত্যু ছুঁয়ে নিতে।
এই জন্ম-মৃত্যু, অগ্র-পশ্চাৎ গমন কলায় দেখি আমাদের বর্তমানকে ছেড়ে আসা অতীতবেলা ভূত-ভবিষ্যৎকে ভেঙে ফেলছে এবং মর্মরিত পাতার মতো- ফেনিল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মথিত হতে থাকা হৃদকমল চিন্তার অযুত রশ্মি বিছিয়ে দিচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায়। এই আহত বর্ণিল শোভাযাত্রায় কবি বিস্ময়াবিভূত কিংবা দ্বিরুক্ত প্রশ্নের আভায় মোমের প্রদীপ জ্বেলে জানাচ্ছেন—
আমারও প্রাণের আয়ু শেষ হয়ে যেতেছে তাহলে,
একটি নিশ্বাস থেকে মনে হয় আরেক নিশ্বাসে
আমিও যেতেছি কমে, যে রকম ধীরে ধীরে গলে
মোমের প্রদীপ জ্বলে আগুনের উত্তাপে, বাতাসে।
কবি কি সংশয়দীর্ণ নাকি সংশয় উত্তীর্ণ? নাকি সংশয়-নিঃসংশয়ের মাঝামাঝি দুলতে দুলতে আমাদেরকে বেঘোরে চূর্ণ করেন ভেতরে-বাইরে? কবির কর্ম কি তাই? এই কর্মের ফলেই কি মানব-বোধের যাত্রা পরিপূর্ণ-পরিপুষ্ট হয়? আমাদের এই আশার প্রশ্নের সমান্তরাল কি কবির বাক্য—
তাহলে, কী হবে, যদি আমারও সময় শেষ হয়
কী হবে, হে প্রভু, পাব সে মুহূর্তে তোমার আশ্রয়?
উৎস হতে বিচ্ছুরিত হয়ে উদ্দিষ্ট কর্মে নিয়োজিত থেকে আমাদের প্রত্যাগমন প্রত্যাশার অমিমাংশিত আলোচনায় কবির বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। সেই সব জানা-অজানা পথ-পরিক্রমায় সময়-স্বপ্ন-কল্পনার মুখোমুখি থেকে আনন্দ-উল্লাস-আতংক-সংশয় নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে দুঃস্বপ্নের গানও কবি গান—
এখন ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না
ভয়ে গোঙাতে থাকি আঁ আঁ করে;
মনে হয়, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি
আমাকে ধরতে আসছে বন্দুকধারীরা,
চিৎকার করতে যাই অ্যাপাচি অ্যাপাচি
কিন্তু কথা বের হয় না মুখ দিয়ে
শুধু গোঙাতে থাকি আঁ আঁ করে
এই গোঙানি কার? কবির একার? নাকি দেশের নিপীড়িত, যুদ্ধবিরোধী কবির? আমাদের ভাববার অবকাশে কবি জানান, তিনি স্থানোত্তীর্ণ হলেও তার স্থানের মানুষ। তিনি বাংলা ঘুরে বাংলার পাবনাতে ফিরে আসেন, আমাদের খোঁজার কাজে নিযুক্ত করেন, কোথায় ভেড়ামারা কলেজ, কোথায় কলেজের উত্তর দিকের প্রস্রাবখানা, কোথায় লেগে আছে গুলির দাগ? আর কোথায় জনতা ব্যাংক, তার সামনে ছড়ানো ছিটানো লাশ, যেসব কুকুরের খাদ্য ছিল তখন? কবির ভাষায়—
হঠাৎ দেখি বিশাল শরীরের দুটো লাশ কুকুরে খাচ্ছে
মনে হলো, বিদেশি সৈন্য
তাদের হাড় মড় মড় করে চিবোচ্ছে কুকুর
ভেড়ামারা কলেজের উত্তর দিকে প্রস্রাবখানার দেয়াল
রাইফেলের গুলিতে ছিদ্র হয়ে আছে
যেমন দেখেছিলাম পাবনা জনতা ব্যাংকের...
নারকীয় পাবনা শহর...লাশ আর ছড়ানো ছিটানো ট্রেসার লাইটে
তারপরেও দুঃস্বপ্নকে অতিক্রম করে কবি আছেন প্রেমে-ভালোবাসায়। শিশিরসিক্ত ভোরের মোহ নিয়ে কবি বৈশাখে উঠে আসেন প্রেমের আরতি নিয়ে। কবি জানেন, ভালোবাসা মূলত নবায়নযোগ্য এবং একে হালনাগাদ করতে হয়। কবি তাই প্রতি বৈশাখে বাংলার ঐতিহ্যে আমোদিত ও প্রাণিত হয়ে তার ভালোবাসাও নবায়ন করেন অতীতের ব্যর্থতা-বেদনার ধুলো ধুয়ে মুছে। নিবেদিত প্রেমকে নতুন করে সাজিয়ে নেন যাতে আগামির ঝরে ভেঙে না যায়। যদিও কবি জানেন—
শেষ পর্যন্ত চাঁদ ডুবে যাবে, নক্ষত্র ডুববে আকাশে
ভালোবাসার সাম্পান গোণ্ডলা ডুববে না।
কবির শিষ্য হয় স্থান-কাল অতিক্রম করে স্থানোত্তীর্ণ-কালোত্তীর্ণ। আমাদের কবি ওমর আলীর সেই পরম্পরা কেমনতর তার রেখাদৃশ্য আমরা হয়তো দেখার কসরত করবো।
কবি মজিদ মাহমুদকে উদ্ধৃত করে শেষ করবো, 'আমাদের কবিতার ইতিহাসও যে রাজনীতি ও রাজধানীকেন্দ্রিক, ওমর আলী তার যথার্থ শিকার। নানা রাজনৈতিক প্রয়োজনে, রাজা পরিবর্তনে তারও যেমন প্রয়োজন ছিল না; তাকেও তেমন প্রয়োজন ছিল না। তাই প্রচারের পাদপ্রদীপের বাইরেই থেকে গেছেন তিনি চিরকাল।'
Comments