দেশভাগের ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত এক হৃদয়
গল্পকার সাদাত হাসান মান্টো নিজের এপিটাফ নিজেই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন—'এইখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাদাত হাসান মান্টো। তার সঙ্গে মাটি-চাপা পড়ে আছে ছোটগল্প রচনার যাবতীয় কারুকৃতি আর প্রহেলিকা। মাটির নিচে শুয়ে তিনি আপনমনে ভাবছেন, তাদের দু'জনের মধ্যে মহত্তর ছোটগল্প লেখক কে—ঈশ্বর না তিনি?'
লাহোরে মান্টোর কবরে আজও পরিষ্কার উর্দুতে খোদাই করা আছে এই ফলক।
গল্পের ক্ষেত্রেও এই এপিটাফে লেখা বাক্যগুলোর মতোই সৎ এবং আপসহীন ছিলেন উর্দু ভাষা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ছোটগল্পের সবচেয়ে বড় নাম সাদাত হাসান মান্টো। মান্টো সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন দেশভাগের ধারালো ছুরির আঘাতে, আর তার লেখায় তাই উঠে এসেছে উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দেশভাগের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী গল্পগুলো।
মান্টোকে নিয়ে সিনেমা হয়েছে, লেখা হয়েছে হাজারো নিবন্ধ। কিন্তু মান্টোর নিজের জীবন সিনেমার চেয়েও বেশি সিনেমাটিক। এমনকি তার লেখা গল্পকেও হার মানিয়ে দিতে পারে। হয়তো চাইলেও এমন ট্র্যাজেডিক গল্প মান্টো নিজে লিখতে পারতেন না।
তেতাল্লিশ বছরের ছোট্ট জীবন মান্টোর। কিন্তু তিনি যে মান্টো—ক্ষণজন্মা গল্পকার সাদাত হাসান মান্টো। তেতাল্লিশকে সংখ্যায় পরিমাপ করা যায়, কিন্তু মান্টোর কাজকে না সংখ্যায়, না কোনো ছকে মাপা যায়।
এই ছোট্ট জীবনে মান্টো লিখেছেন ২২টি ছোটগল্প সংকলন, একটি উপন্যাস, রেডিও নাটকের সাতটি সংকলন, তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং দুইটি স্মৃতিকথা।
দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, দাঙ্গার আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিদ্বেষ নিপুণ দরদে উঠে এসেছে মান্টোর লেখায়।
সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে স্ক্রিপ্ট লেখার চেষ্টা করেছিলেন শুধুমাত্র পরিবারের খরচ ও মদের টাকা জোগাড়ের জন্য। কিন্তু মুদ্রার এপিঠে মান্টোর গল্পের সফলতার মতোই ওপিঠে ছিল ব্যর্থতা। শেষ জীবন কেটেছে অভাব-অনটন আর বিষাদগ্রস্ততায়, সঙ্গে ছিল দেশভাগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানসিক অবস্থান।
ইংরেজি সাহিত্য উর্দুতে অনুবাদের চাকরি নিয়ে গল্পের স্বকীয় ধারা খুঁজে পান মান্টো। হয়ে ওঠেন সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় গল্পকার। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে রেডিওর জন্য শ্রুতি নাটক লিখে খ্যাতি পান। এর মধ্যেই প্রকাশ পায় তার বেশ কিছু বিখ্যাত গল্প।
এরপর সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় শুরু করেন হিন্দি সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। বলিউডে তিনি গল্প লিখেছেন—'আট দিন', 'চল চলরে নওজোয়ান', 'মির্জা গালিব'-এর মতো ছবিতে। কিছুটা সফলতাও আসছিল। ঠিক তখনই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের দামামা বেজে ওঠে।
১৯৪৭-এর শুরুতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আভাস টের পান মান্টো। আর বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম পরিচয়ের কারণে তাকে একাধিক সিনেমা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
পরিবার ও নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রিয় শহর বোম্বে ছেড়ে লাহোরের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন মান্টো। সঙ্গে নিতে পারেননি কোনো অর্থ বা সম্পত্তি। ফেলে আসেন নিজের শেকড় আর সবকিছু।
এখান থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যয়ের শুরু। এই সময়েই লেখেন 'টোবাটেক সিং', 'ঠান্ডা গোশত'-এর মতো গল্প। সেখানে বেদনাবোধ নেই, রসবোধ নেই। শুধু আছে এমন গল্প—যা রক্ত হিম করে দেয়, ঘুম কেড়ে নেয়।
অর্থনৈতিকভাবে তিনি দাঁড়াতে পারেননি কোনোদিনই। লাহোরের পত্রিকা ও সিনেমা মহল তার সম্ভাবনা বুঝলেও বাস্তবতা ছিল কঠিন।
একসময় অশ্লীলতার অভিযোগে লেখা ছাপা হতো না। একইসঙ্গে আপসহীন মানসিকতায় তিনি হয়ে ওঠেন চক্ষুশূল। ভারতে বন্ধুদের বারবার চিঠি লিখে তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন, কিন্তু ততদিনে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সীমান্ত সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।
ভারত থেকে তিনি কিছুই না আনলেও একটি মামলা তার পিছু ছাড়েনি। 'বিটার ফ্রুট' গল্পে অশ্লীলতার অভিযোগে ব্রিটিশ আমলে হওয়া মামলা দেশভাগের পর পাকিস্তানেও টেনে আনা হয়। অর্থাভাবে সেই মামলাও জীবদ্দশায় নিষ্পত্তি করতে পারেননি মান্টো।
সংসার চালাতে না পেরে পত্রিকা অফিসে ধরনা দিতেন—আমাকে কিছু টাকা দিন, লিখে শোধ করে দেব।
নিয়মে না চলায় সম্পাদকের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো। হতাশার সঙ্গে পুরোনো মদের অভ্যাস আরও গভীর হয়। সস্তা মদের নেশায় লিভারে বাসা বাঁধে সিরোসিস।
এই অবস্থাতেই কাঁপা হাতে ১৯৪৮ সালে প্রকাশ করেন 'সিয়াহ হাশিয়ে'। সেখানে এক লাইন থেকে দেড় পাতার গল্পে উঠে আসে দেশভাগের কালো সীমানা।
বন্ধুহীন মান্টোর গল্পের সুবিধা নিয়ে বিনিময়ে সস্তা মদ দিতে শুরু করে কিছু মানুষ। তারাই হয়ে ওঠে তার শেষ দিনের সঙ্গী।
১৯৫০ সালে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই মারা যান সাদাত হাসান মান্টো।
একবার তিনি বলেছিলেন, 'একদিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে মেডেল পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।' সরকার তা করেছেও।
তবে বিশ্বে যতদিন মান্টোর গল্প বেঁচে থাকবে, তাকে অপমান করার সাহস আছে আর কার!


Comments