‘ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা গন্ধ উড়িছে বায়’

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

শিরোনামে উদ্ধৃত পঙ্‌ক্তিটি নেওয়া হয়েছে বাংলা সাহিত্যর অনবদ্য আখ্যানকাব্য 'নকশী কাঁথার মাঠ' থেকে।  

পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীনের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় এই আখ্যানকাব্যের দশম অনুচ্ছেদের এ অংশটুকু এরকম—'ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,/কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।/আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,/মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে।'

এর আগের পঙ্‌ক্তিগুলোতে কবি আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিক মাসে যে নতুন ধান ওঠার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন, তা মূলত আমন।

আর এই প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত ছবিটি বোরো মৌসুমের হলেও বাংলার প্রান্তরজুড়ে সব মৌসুমে ধান কাটা, মাড়াই কিংবা প্রক্রিয়াজাতকরনের চিত্র মোটামুটি একই রকম।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে মাঠে মাঠে পেকে ওঠা সোনালি ধানের অপূর্ব শোভা যে চিত্রময়তা বাঙালির মানসপটে এঁকে দেয়, তার অনেকটা ধরা পড়ে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ রচিত আমাদের জাতীয় সংগীতেই। আবার 'ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা' দেখে বিমোহিত হওয়ার বর্ণনাও পাওয়া যায় তার আরেকটি গানে।

ধানকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ দানা শস্য। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে এক লাখ ৪০ হাজার বিভিন্ন জাতের ধানের কথা জানা যায়। ভারতের পরিবেশবিজ্ঞানী ও ধান সংরক্ষক দেবল দেব জানাচ্ছেন, ষাটের দশকের শেষের দিকে সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার আগে ভারতে ৪২ হাজারেরও বেশি স্থানীয় জাতের ধানের চাষ হতো।

এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য বলছে, গত শতাব্দীর শুরুর দিকেও এ অঞ্চলে ১৮ হাজার স্থানীয় জাতের ধান ছিল। গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতেও ব্রি সারাদেশে আবাদকৃত প্রায় ১২ হাজার ৫০০ জাতের নাম সংগ্রহ করেছিল। আর এখনো ব্রি'র জিন ব্যাংকে আট হাজারের বেশি স্থানীয় জাতের ধানের জার্মোপ্লাজম সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ এক শতাব্দীর ভেতর ১০ হাজারের বেশি স্থানীয় জাতের ধান পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।

এখনো বাংলাদেশের পাহাড় থেকে সমতল অঞ্চলে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি জাতের ধানের আবাদ হয়। তবে অধিক উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় মাত্র কয়েকটি জাতের ধান।

এগুলোর মধ্যে আছে রোপা আমন হিসেবে পরিচিত উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান ৮৭, ব্রি ৭১, ব্রি ৭৫ ও ব্রি ৭৬। এ ছাড়া বোরো মৌসুমে এক সময় জনপ্রিয় ছিল ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯। এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ব্রি ৯৬।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর প্রায় ৫০ দশমিক ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে।

কৃষিবিদ ড. মো. রওশন জামাল 'পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিতে বোরো ধানের আবাদ' শিরোনামের এক লেখায় বলছেন, 'ভেতো বাঙালির ভাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেচনির্ভর উচ্চফলনশীল বোরো ধান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বোরো ধান এখন দেশের প্রধান ধানের মৌসুম। বোরো মৌসুমে মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬০ শতাংশ উৎপাদিত হয়। যদিও ব্যাপকভিত্তিতে বোরো ধানের আবাদ বেশি দিনের নয়।'

ওই লেখায় আরও বলা হচ্ছে, সেচপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের আগের সময়ে ধানের প্রধান মৌসুম ছিল আমন ও আউস। উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ফলে আউস ধানের আবাদ কমতে থাকে এবং অব্যাহতভাবে আবাদ বাড়তে থাকে সেচনির্ভর বোরো ধানের।

ছবিতে খুলনার পশ্চিম বিলপাবলা এলাকায় পাকা বোরো ধান খেত থেকে কেটে মাড়াইয়ের পর কুলার বাতাস দিয়ে মরা অর্থাৎ চিটা ধান আলাদা করতে দেখা যাচ্ছে কৃষকদের।

এ এলাকার কৃষকদের ভাষ্য, চলতি মৌসুমে বোরোর ফলন খুবই ভালো হয়েছে। পাইকারিতে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে।   

Comments

The Daily Star  | English

‘Polls delay risks return of autocracy’

Says Khandaker Mosharraf after meeting with Yunus; reiterates demand for election by Dec

2h ago