হাঁসের খামার বদলে দিচ্ছে চলনবিলের অর্থনীতি

প্রাকৃতিক নিয়মে বর্ষা থেকে শীতের শুরু পর্যন্ত প্রায় ৫ মাস জলমগ্ন থাকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম জলাভূমির অঞ্চল চলনবিল। এ সময় বিলের পানিতে ভেসে বেড়ায় নানা প্রজাতির মাছ। তখন মাছ শিকার ছাড়া কোথাও কোনো কাজ থাকে না। ফলে বিশাল বিলাঞ্চলের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পরে।
তবে প্রকৃতির ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা চলনবিলের মানুষ এখন বিশাল জলরাশিতে মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি হাঁস পালনের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছে সফলতার দুয়ার। যেসব পরিবার শুধু মাছ বা ধান চাষের ওপর নির্ভর করে, তাদের অনেকের কাছেই এখন হাঁস হয়ে উঠেছে নতুন জীবনরেখা।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ গ্রামের মোমেনা খাতুন একসময় পুরোদস্তুর গৃহিণী ছিলেন। তিনিই এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
কয়েক দশক আগে তার পরিবার পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল মাঠের ফসলের ওপর। কিন্তু বর্ষার কারণে প্রায় ৫-৬ মাস জমিতে যাওয়া অসম্ভব হয়ে যাওয়ায় দারিদ্র্য তাদের পিছু ছাড়ছিল না। এরপর তিনি ৩০টি হাঁস কিনে বিলের পানিতে পালতে শুরু করলেন।
মোমেনা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম বছরে যা লাভ হয়েছিল, তাতে আমি দ্বিতীয় বছরে ১০০টি হাঁস নিয়ে খামার আরও বড় করি। কয়েক বছর হাঁস চাষ করে এখন আমার আর অভাব নেই। চলনবিলের মান্নাননগরে অস্থায়ী হাঁসের খামারে এখন আমার রয়েছে হাজারের বেশি হাঁস।'
মোমেনা জানান, উৎপাদন ভালো হলে প্রতি হাজার হাঁস থেকে সহজে বছরে ন্যূনতম ৩০ হাজার টাকা আয় করা যায়।
মোমেনা খাতুন এখন এই অঞ্চলের হাঁস পালনের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা।
গত দুই দশকে চলনবিলের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জে ২০০টির বেশি হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়গুলোর তথ্য অনুযায়ী, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জে প্রায় ২৫ লাখ হাঁস পালন করা হয়। ছোট আকারের পারিবারিক খামারগুলো নথিভুক্ত না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
অধিকাংশ খামার সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া এবং নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম ও সিংড়া উপজেলায়।
সিরাজগঞ্জে ১৩ লাখ ২৬ হাজারের বেশি হাঁস পালন করা হয়। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা একেএম আনোয়ারুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশাল জলাভূমিতে রয়েছে প্রচুর খাবার এবং হাঁস বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ। একারণে খামারগুলো অবিশ্বাস্যভাবে লাভজনক হয়ে উঠেছে।'
নাটোরের গুরুদাসপুরের বিলহরি গ্রামের প্রবীণ খামারি মো. বজলুর রহমান বলেন, 'বর্ষার পানি বিলে আসার আগেই আমরা একদিন বয়সী হাঁসের বাচ্চা নিয়ে আসি এবং এক মাস শেডে তাদের পরিচর্যা করি। এরপর হাঁসের বাচ্চা ছেড়ে দেই বিলে।'
পাঁচ মাসের মধ্যে হাঁসগুলো ডিম দেওয়া শুরু করে বলে জানান তিনি।

নাটোরের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. সেলিম উদ্দিন জানান, জেলার তিন উপজেলায় ৬ লাখ ৯০ হাজারের বেশি হাঁস পালন করা হয়, যেগুলো বছরে ৫ কোটি ডিম ও ৯ হাজার টন মাংস উৎপাদন করে।
তিনি বলেন, 'বাণিজ্যিক হাঁস পালন চলনবিলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। হাঁস পালনের জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ স্বল্প খরচ। জলাধারের পাশে শুধু একটা চালা তৈরি করলেই যথেষ্ট। আর কোনো বাড়তি প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না।'
প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে নিয়মিত টিকা দিয়ে হাঁসকে সুস্থ রাখা হয় বলে জানান তিনি।
হাঁস পালনের একটি স্থায়ী সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ ডিম স্থানীয় হ্যাচারিগুলোতে যায়, যেখানে সেগুলোকে তা দিয়ে নতুন হাঁসের বাচ্চা ফোটানো হয়। বাকি ডিম জেলা ও জেলার বাইরে বাজারগুলোতে বিক্রি হয়।
স্থানীয় খামারি মো. সাদ্দাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বেশিরভাগ ডিম চলনবিল এলাকার হ্যাচারিগুলোতে সরবরাহ করি। সিরাজগঞ্জের মান্নাননগর ডিম ও হাঁসের বাচ্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।'
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় পল্লী হ্যাচারির মালিক মো. মঞ্জু বলেন, 'এ অঞ্চলে প্রায় ১০০টি হ্যাচারি আছে, যা প্রতি মাসে লাখ লাখ ডিম কেনে। আমি একাই মাসে ৪০ -৫০ হাজার ডিম কিনি।'
হাঁস পালনের বিকাশের ফলে অন্যান্য নতুন আয়ের পথও তৈরি হয়েছে। হাঁস শামুক খেতে পছন্দ করে, যা অনেককে শামুক ধরে বিক্রি করতে উৎসাহিত করেছে।
তাড়াশ উপজেলার একজন শামুক সংগ্রাহক আব্দুল মোতালেব বলেন, 'প্রতি বস্তা শামুক ৩৫০-৪০০ টাকায় বিক্রি হয়।' বিল জুড়ে শামুক সংগ্রহের জন্য প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ নৌকা ব্যবহার করা হয়।
তবে এই অভ্যাস উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সিরাজগঞ্জের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান সতর্ক করে বলেন, 'শামুক জলাভুমির প্রাকৃতিক পরিশোধক হিসেবে কাজ করে। ব্যাপক হারে শামুক নিধন করলে পানি দুষিত হয়ে পরতে পারে। যদি প্রাকৃতিক জল পরিশোধন প্রক্রিয়া হারিয়ে যায়, তবে দূষণ বাড়বে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশাল জলরাশিতে বাণিজ্যিক হাঁস পালন বাড়লেও, জলের অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।'
একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস বিবেচনা করে আমাদের প্রাণী চাষের উন্নয়ন করতে হবে। কোনো একটি প্রজাতির সংখ্যা এতটা বাড়ানো উচিত নয় যে তা অন্যদের ক্ষতি করে।'
তবে সিরাজগঞ্জের প্রানি সম্পদ কর্মকর্তা বলেন, হাঁস পালনে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। চলন বিলে প্রাকৃতিক শামুকের যথেষ্ট মজুদ আছে। এখানে হাঁস পালনে কোনো ক্ষতি নেই।
একসময় চলন বিল প্রচুর মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং আবাসস্থল হারানোর কারণে সেই খ্যাতি কমে গেছে। মাছ ধরা কম হওয়া এবং শস্যক্ষেত্র প্লাবিত হওয়ার মুখে, স্থানীয়রা প্রয়োজনকে উদ্ভাবনে পরিণত করেছে।
Comments