নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের স্বাধীনতায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আপত্তি

সচিব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা নিয়োগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রস্তাবটির সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একমত হয়নি। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্কার প্রস্তাব আলো মুখ দেখবে না।

তারা মনে করেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের স্বায়ত্তশাসন জোরদার ও কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করছে এমন সিদ্ধান্ত।

সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে 'নির্বাচন কমিশন সচিবালয় (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-২০২৫'-এর খসড়া পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সেখানে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনার জন্য একটি পৃথক 'নির্বাচন কমিশন সার্ভিস' গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবটি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

নির্বাচন কমিশন সার্ভিসের উদ্দেশ্য হলো সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া। এছাড়া এর মাধ্যমে কমিশন কর্মীদের জন্য একটি কাঠামোবদ্ধ ক্যারিয়ার পথ তৈরি হবে, যাতে তারা সচিবালয়ের উঁচু পর্যায়ের পদে এগিয়ে যেতে পারেন।

বিদ্যমান নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, কমিশনের বাইরের কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বিভিন্ন পদে কাজ করতে পারেন।

বর্তমানে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। কমিশন সূত্র জানায়, আরও অন্তত ১০টি মধ্যম পর্যায়ের পদে প্রশাসন ক্যাডার বা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন।

গত ১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের খসড়া আইন পর্যালোচনা বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। তাদের যুক্তি, নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের সার্ভিস গঠন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।

কোনো খসড়া অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদের সামনে উপস্থাপন করার আগে তা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব এই কমিটির।

বিশেষজ্ঞরা কমিটির এই মতের সঙ্গে তীব্র দ্বিমত পোষণ করেছেন।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রচলিত নিয়ম বা অন্য কোনো আইন ও বিধি উল্লেখ করে সংস্কার উদ্যোগ আটকে দেওয়ার সুযোগ নেই। অজুহাত দেখিয়ে সংস্কার বন্ধ করা হলে আমরা আর কী বলতে পারি?'

তিনি বলেন, 'সংস্কার মানে হলো নতুন কিছু তৈরি করা বা বিদ্যমানকে হালনাগাদ করা। সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হলো পুরনো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখারই চেষ্টা।'

নির্বাচন কর্মকর্তারা বলেন, সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে কমিশন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নয়। তাই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব নির্ধারণকারী নিয়ম এখানে প্রযোজ্য নয়।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন তুলি বলেন, 'কমিশন যদি স্বনির্ভর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে চায়, তাহলে সবপর্যায়ে নিজেদের কর্মকর্তা থাকতে হবে।'

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যে কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় সরকারি আদেশ মানতে মানতে কাটিয়েছেন, তিনি হঠাৎ কীভাবে একটি সাংবিধানিক সংস্থায় স্বাধীনভাবে কাজ করবেন?'

২০০৭ সাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ছিল। পরে ২০০৯ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন সংশোধন করে সচিবালয়কে কমিশনের অধীনে নিয়ে আসে।

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসন ক্যাডারসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাকে কমিশনের কয়েকটি পদে প্রেষণে পাঠানোর বিধান রাখা হয়।

কমিশন কর্মকর্তাদের মতে, এই বিধান কমিশনকে পুরোপুরি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকরভাবে পরিচালনার পথে বড় বাধা।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন সাবেক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে সচিবালয়ের কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে।

এক সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দোষারোপ করা অন্যায়। কারণ, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে কর্মকর্তাদের সরকারই বাধ্য করে।'

স্থানীয় নির্বাচনে সাধারণত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় উপ-কমিশনার ও বিভাগীয় কমিশনারদের, যারা সবাই প্রশাসন ক্যাডারের।

দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন কর্মকর্তারা এই প্রথা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন।

৩০ আগস্ট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সমিতি দাবি জানায়, সরকারকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সার্ভিস গঠন করতে হবে। তা না হলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে বলে তারা সতর্ক করেন।

এনআইডি নিয়ে 'বিরোধপূর্ণ' অবস্থান

খসড়া অধ্যাদেশে 'জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেস প্রণয়ন ও সংরক্ষণ'র দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল।

তবে ১৯ আগস্টের বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি এই প্রস্তাবটিও প্রত্যাখ্যান করে। তাদের যুক্তি, এটি এনআইডি ডেটাবেসের জন্য পৃথক আইনগত সংস্থা গঠনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপন্থী।

নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা এটিকে দ্বিমুখী মানদণ্ড হিসেবে দেখছেন।

নির্বাচন কমিশনের এক উপসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'কমিটি পৃথক নির্বাচন কমিশন সার্ভিস গঠনে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবটি বিবেচনায় নেয়নি। কিন্তু এনআইডি ডেটাবেসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে তারা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের উল্লেখ করেছে। এটা তো স্ববিরোধী অবস্থান।'

Comments

The Daily Star  | English

Ducsu AGS candidates: Rights, safety, reforms their top agendas

A total of 25 candidates are contesting for the post of assistant general secretary (AGS) in this year's Dhaka University Central Students' Union (Ducsu) election, scheduled for September 9.

13h ago