‘এই আকালেও আনাগোনা করে নাছোড়বান্দা পাখি’

ছাদের অ্যান্টেনার ওপর বুলবুলি পরিবার। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

বাগানে ফুলকলিদের ঘুম যাতে কোনোভাবেই ভেঙে না যায়, সে জন্য বুলবুলিকে ফুল-শাখাতে দোল না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন নজরুল। তবে ২০২৩ সালে এসে এমন বাগানহীন, বৃক্ষহীন শহরে ছাদের ওপর টানানো অ্যান্টেনায় বুলবুলিকে দোল দিতে দেখলে তিনি ঠিক কী বলতেন, তা ধারণা করার কোনো উপায় নেই।

ঢাকা নামের এই ঊষর-বিবর্ণ-হতশ্রী মহানগরে সবুজের স্নিগ্ধতা ঘুচে গিয়েছে অনেক আগেই। উঁচু উঁচু সব দালানকোঠা আর অপরিণামদর্শী সব প্রকল্পের ভিড়ে আমাদের প্রিয় ঋতুগুলোর মাধুর্যতা ও বর্ণাঢ্যতাও এখানে প্রায় অনুপস্থিত। এখানে সব থাকলেও নেই কোনো উদ্ভিদ আয়োজন।

শহর কলকাতার প্রেক্ষাপটে কবীর সুমন একবার পাড়ার পার্কের অবস্থা বর্ণনায় গেয়েছিলেন, 'এদিকে–ওদিকে দেখি, কিছু গাছ আছে বাকি/এই আকালেও আনাগোনা করে নাছোড়বান্দা পাখি।'

কিন্তু ঢাকার ন্যাড়া পার্কগুলোতেও ইদানীং গাছের দেখা পাওয়াটা দুষ্কর। তাই বুঝি 'নাছোড়বান্দা' বুলবুলিও পরিবারসমেত আস্তানা গেড়েছে সামান্য বাতাসেই দুলে ওঠা অ্যান্টেনার ওপর।

সম্প্রতি এই বিরল দৃশ্যটি দেখা যায় ফার্মগেট এলাকায় দ্য ডেইলি স্টার সেন্টার সংলগ্ন এক ভবনের ছাদে। মাথায় ঝুঁটিওয়ালা বাবা পাখিটিকে দেখে বোঝা যায় সেটি সিপাহি বুলবুলি।

ছানার জন্য খাবার মুখে বাবা বুলবুলি। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

এমনিতে মানুষের বাসস্থানের সুবিধাজনক জায়গায় বুলবুলির বাসা বানানোর ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। কখনো কখনো যাত্রীবাহী বাসের ভেতরও এরা বাসা বানিয়ে ফেলে। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা আছে এই পাখিটির। নিজেদের মধ্যেও মারামারিতে সিদ্ধহস্ত এরা। পাখি বিশারদরা তাই বুলবুলিকে অভিহিত করে থাকেন 'লড়াইবাজ' হিসেবে।

এক সময় এদেশে পোষা বুলবুলির লড়াই হতো। বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতার প্রভাবে পাখিদের বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকি যেখানে ক্রমশ বেড়েই চলছে, সেখানে বুলবুলি বেশ সাফল্যের সঙ্গে বেঁচেবর্তে আছে। গত কয়েক দশকে এদের সংখ্যাও বেড়েছে। এ কারণেই প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন-আইইউসিএন বুলবুলিকে জায়গা দিয়েছে 'ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত' প্রজাতির তালিকায় স্থান দিয়েছে।

সিপাহি বুলবুলির সৌন্দর্য বর্ণনায় পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক শরীফ খান বলছেন, 'আহারে সৌন্দর্য পাখিটির শরীরে! বেশি সুন্দর বোধ হয় মাথা-কপালের ওপরকার লম্বা-খাড়া চকচকে কালো রঙের ঝুঁটিটা। গলার তুলট-সাদা পালকগুলো ফুলে ফুলে দুলে দুলে ওঠে গান গাওয়া বা ডাকার সময়। সে এক দারুণ সৌন্দর্য!'

খাবার নিয়ে বাসার পথে উড়ান। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

সিপাহি বুলবুলির চোখের নিচটায় টকটকে আলতার মতো রঙ। ঘাড় থেকে বুকের পাশ অবধি নেমে গেছে চওড়া কালো রঙ। বুক-পেট সাদাটে। পা ও ঠোঁট কালো। ঘাড়-পিঠ কালচে বাদামি।

শরীফ খান জানাচ্ছেন, সিপাহি বুলবুলির মূল খাবার নানান রকম ছোট ফল, ফুলের মধুরেণু, পোকামাকড়সহ লার্ভা, শুঁয়াপোকা, গাছের বাকলের তলার পোকা ইত্যাদি।

ঢাকা শহরের নিরিবিলি পার্ক-উদ্যানের ফুলবাগানের পছন্দসই গাছের মাথায় (৪-৭ ফুট উচ্চতায়) বসন্ত-হেমন্তে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২ থেকে ৪টি। ফোটে ১৪-১৮ দিনে। গ্রামবাংলায় এরা বাসা করে ঝোপঝাড়ের মাথায়।

অতি অল্পতেই অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে ওঠার স্বভাবও আছে এই পাখির। ভীষণ চিৎকার করে। লাফালাফি চলতেই থাকে। দাঁড়াশ সাপ, গুইসাপ, বেজি ও বনবিড়ালের মতো শত্রুকে এরা প্রবল বিক্রমে বাচ্চার সীমানা থেকে হটিয়ে দেয়। এমনিতে ভবঘুরে স্বভাবের। তবে বাসা করার পর এক জায়গায় থিতু হয়।

ছানার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে মা বুলবুলি। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

সিপাহি বুলবুলির চালচলনেও আভিজাত্য আছে। মাথায় ঝুঁটির কারণে দেশের কোথাও কোথাও এটি 'রাজবুলবুলি' নামেও পরিচিত। পূর্ণবয়স্ক একটি সিপাহি বুলবুলির দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার। ওজন ২০ গ্রামের মতো। কোকিল এদের বাসায় চুরি করে ডিম পাড়ে। ইংরেজি নাম রেড হুইস্কারড বুলবুল। বৈজ্ঞানিক নাম Pycnonotus jocosus.

সম্প্রতি ডেইলি স্টার সেন্টারের উত্তর পাশে চতুর্থ তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, প্রবল রোদের ভেতর পাশের ভবনের ছাদে অ্যান্টেনার ওপর বানানো বাসায় সদ্যফোঁটা ৩টি ছানাকে দৌড়ঝাঁপ করে খাওয়ানোর কাজে ব্যস্ত বুলবুলি দম্পতি। একবার মা পাখি মুখে করে খাবার আনছে। আরেকবার আনছে বাবা পাখি। এমনিতে চুপচাপ থাকা ছানাগুলো খাবার নিয়ে বাবা-মায়ের আগমনবার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিঁ-চিঁ করে উঠছে।

এই দৃশ্য দেখে জীবনানন্দের 'পাখি' কবিতার কয়েকটি পঙতি মনে পড়ে- 'এই পাখি- এতটুকু- তবু সব শিখেছে সে- এ এক বিস্ময়/সৃষ্টির কীটেরও বুকে এই ব্যথা ভয়;/আশা নয়- সাধ নয়- প্রেম স্বপ্ন নয়/চারিদিকে বিচ্ছেদের ঘ্রাণ লেগে রয়'।

ছাদের ওপর বুলবুলি পরিবারের এসব ক্রিয়াকাণ্ডের ছবিগুলো তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী প্রবীর দাশ

Comments

The Daily Star  | English

Political parties with phantom addresses queue for EC nod

In its application for registration with the Election Commission, Janatar Bangladesh Party has said its central office is located on the 12th floor of Darus Salam Arcade near the capital’s Paltan intersection.

1d ago