হাজিদের সঙ্গে এজেন্সির প্রতারণা

হোটেলে পানি-বিদ্যুৎ থাকছে না, অপর্যাপ্ত খাবার, ১ জনের কক্ষে ৪ জন

প্যাকেজে ঘোষিত হোটেলে না রেখে হাজিদের ‘তারা আজইয়াদ’ নামে নিম্নমানের একটি হোটেলে রাখার অভিযোগ উঠেছে নূর-ই-মদিনা ট্রাভেলস এজেন্সির বিরুদ্ধে। এই এজেন্সির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলমগীর হাসান। ছবি: সংগৃহীত

হজ এজেন্সিগুলোর প্রতারণা ও অনিয়মে হজযাত্রীদের ভোগান্তির বিষয়টি স্বাভাবিক একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

হজ প্যাকেজে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি পূরণ না করে প্রতারণা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এসেছে অনেক এজেন্সির বিরুদ্ধে। কোনো কোনোটির বিরুদ্ধে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছে সরকার। লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি সতর্কও করা হয়েছে।

এবারও গত ২১ মে হজযাত্রীরা সৌদি আরবের মক্কায় পৌঁছানোর প্রথম দিনেই সেখানে প্রতারণা ও ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের শিকার হন। এ কারণে হজযাত্রী পাঠানো ৮টি এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়।

এর মধ্যে গত শনিবার ও গতকাল রোববার মক্কার 'তারা আজইয়াদ' নামে একটি হোটেলে অবস্থানরত বেশ কয়েকজন হাজি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এজেন্সি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এজেন্সির দেওয়া বিজ্ঞাপন অনুসারে তাদের মক্কার হারাম শরিফ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বের হোটেলে না রাখা, খাবার বণ্টনে অনিয়ম ও অপর্যাপ্ত খাবার পরিবেশন, হোটেলে পানি-বিদ্যুতের সমস্যা ও যে কক্ষে ১ জনের থাকার কথা সেখানে কমপক্ষে ৪ জনকে রাখার মতো বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের কাছে।

এই হাজিরা হজ পালন করতে সৌদি আরবে গেছেন নূর-ই-মদিনা ট্রাভেলস এজেন্সির তত্ত্বাবধানে। এই এজেন্সির তত্ত্বাবধানে এবার সৌদি আরবে যাওয়া মোট হাজির সংখ্যা ১৯০ জন।

শনিবার ও রোববার এই হাজিদের মধ্যে টেলিফোনে অন্তত ১০-১২ জনের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। তারা জানান, হজ প্যাকেজের শর্ত অনুসারে তাদের মক্কার হারাম শরিফ থেকে ৫০০-৭০০ মিটার দূরত্বের একটি থ্রি স্টার মানের হোটেলে রাখার কথা ছিল। কিন্তু তাদের ২ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বের 'তারা আজইয়াদ' নামে নিম্নমানের একটি হোটেলে রাখা হয়েছে, যেখানে শনিবার ৩ দফায় ৫ ঘণ্টা পানি ছিল না। এর আগের দিন শুক্রবারও ২ দফায় পানি ছিল না।

হোটেলের ১ জন থাকার কক্ষে ৪ জন হাজিকে রাখার অভিযোগ করে তারা বলেন, 'এক্ষেত্রে নারীদের অবস্থা আরও করুণ। হোটেল কক্ষের অতি সংকীর্ণ জায়গায় বিছানাতেই নামাজ পড়তে হচ্ছে তাদের।'

হাজিরা আরও বলেন, পানির অভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওয়াশরুম ব্যবহারের জন্য ২ কিলোমিটারের বেশি হেঁটে অন্য জায়গায় যেতে হচ্ছে তাদের।

এছাড়া শর্ত অনুসারে হজের ৫ দিন মক্কা-মিনা-আরাফা-মুজদালিফা রুটে উন্নতমানের সার্ভিস বাস দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।

তারা আরও জানান, সঙ্গে দেওয়া হয়নি কোনো গাইড।

এই হাজিরা বলছেন, নূর-ই মদিনা ট্রাভেলস তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা হাজিদের নিয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলেছিল। অনেকে যখন বিভিন্ন অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে ওই গ্রুপে অভিযোগ জানাতে শুরু করেন তখন সেখানে মন্তব্য লেখার অপশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া এজেন্সির পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়, ধর্ম মন্ত্রণালয় কিংবা সৌদি দূতাবাসে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না।

এ বিষয়ে সেখানে অবস্থানরত এক হাজি বলেন, 'ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করার পর থেকে খাবারের ওপর খড়গ নেমে এসেছে। এক রুমে থাকা ৫ জনের জন্য দেওয়া হচ্ছে ২টি সেদ্ধ ডিম, ৪টি কলা, ৮ পিস রুটি। অথচ বিজ্ঞাপনে ২ বেলা দেশি বাবুর্চির রান্না করা খাবার দেওয়ার কথা ছিল আমাদের।'

নূর-ই-মদিনা ট্রাভেলসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলমগীর হাসানও বর্তমানে সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থান করছেন। সাউথ এশিয়ান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এবং অ্যারোনেট ইন্টারন্যাশনাল নামে আরও ২টি এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি।

গত শনিবার রাতে আলমগীর হাসানের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় ডেইলি স্টারের। আলমগীর হাসান হাজিদের তোলা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তারা আজইয়াদ হোটেল কক্ষে হাজিদের সঙ্গে নূর-ই-মদিনা ট্রাভেলস এজেন্সির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলমগীর হাসান। ছবি: সংগৃহীত

রোববার দুপুরে অভিযোগকারী হাজিরা তাকে নিজেদের হোটেলে নিয়ে আসেন। সেখানে মোবাইলের স্পিকার অন করে তার সামনে অভিযোগের কথাগুলো আবার বলেন। তখন আলমগীর অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তবে বিভিন্ন রকমের যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে শোনা যায়। স্পিকার অন করা ফোনটি একজন হাজি আলমগীর হাসানকে দেন। তখন ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে হাজিদের অভিযোগগুলো বিষয়ে আবারো জানতে চাওয়া হয়। এবার হাজিদের সামনে পূর্বের মতো অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তিনি খাবার সংকট ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বিষয়ে বলেন, 'ব্যবস্থাপনায় কিছু সমস্যা থাকবেই। খাবার সমস্যা অভিযোগ পেলে সমাধান করা হচ্ছে।'

হোটেলে পানি, বিদ্যুৎ না থাকা বিষয়ে বলেন, 'এটা হোটেলের সমস্যা, আমার সমস্যা না। এখানে আমার কিছু করার নাই।'

থ্রি স্টার মানের হোটেলে পানি, বিদ্যুৎ থাকবে না কয়েক ঘণ্টা, এটা কি হতে পারে? প্রতিজন থেকে আপনি নিয়েছেন, ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭৫০ টাকা। তাদের কি এই সেবা প্রাপ্য? এসব প্রশ্নের জবাবে আলমগীর হাসান বলেন, 'এখন হোটেলে পানি না থাকলে, বিদ্যুৎ না থাকলে আমার কিছু করার নাই।'

হোটেলের দূরত্ব ও বাস না দেওয়া বিষয়ে তিনি বলেন, 'দূরত্ব ৭০০ মিটার, হেঁটেই যাওয়া যায়।'

গুগল ম্যাপে তো দেখায় দূরত্ব ২ দশমিক ২ কিলোমিটার।

'গুগল ২ কিলোমিটার দেখালেও দূরত্ব ৭০০ মিটারই, লোক পাঠিয়ে দেখেন।'

আমাদের একজন লোক গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। তিনিও জানিয়েছেন, হারেম শরিফ থেকে 'তারা আজইয়াদ' হোটেলের দূরত্ব ২ কিলোমিটারের বেশি। তবুও আপনি বলবেন দূরত্ব ৭০০ মিটার?

এরপর আলমগীর হাসান কথা না বলে নিরব থাকেন।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে সম্পূর্ণ কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে।

ওই হোটেলে করা একটি ভিডিওতে এক হাজিকে আলমগীর হাসানের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, 'আপনি যে কয়টা মানুষ নিয়ে আসছেন সেই মানুষগুলোর প্রতি আপনার তো একটু খেয়াল থাকবে। হজে আসলে এমনিতেই মানুষ একটু ধৈর্য সহকারে চলার চেষ্টা করে। আমরাও সেটাই করছি। শুধু কান্দি নাই রাস্তায় দাঁড়ায়ে।'

মো. আকতার হোসেন চ্যালেঞ্জার ট্রাভেলার্স নামে একটি এজেন্সিতে টাকা জমা দিয়েছিলেন। তার বাবা-মাকে সৌদি আরবে পাঠানো হয় অন্য একটি এজেন্সির মাধ্যমে। রাখা হয় মক্কার 'নাজমাত আল-রুশাদ' হোটেলে। এই হোটেলটি হারাম শরিফ থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে। তিনি বলেন, 'আমার বাবা-মা সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। এজেন্সি এমন প্রতারণা করেছে যে, সেখানে টয়লেটে যাওয়া যায় না, এসি নষ্ট। বাবা-মা ২ জনেই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ৩ বার ডাক্তার দেখিয়েছেন। হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়েছে।'

জাপান প্রবাসী মো. মোখলেসুর রহমান ঢাকা হয়ে আলমগীর হাসানের ১৩০ জনের সঙ্গী হয়েছেন। তার ফিরতি ফ্লাইট ঢাকায় পৌঁছাবে ২০ জুলাই রাত ১২ টায়। তার টোকিও ফ্লাইট সেরাতেই ২টায়। এভাবে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় তিনি তারিখ পরিবর্তন করতে গিয়ে দেখলেন 'ফিক্সড টিকেট' পরিবর্তনের সুযোগ নেই। ফলে তাকে নতুন করে ২১ জুলাইয়ের টিকেট কাটতে হয়েছে। এ বিষয়ে আলমগীর হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেভাবে কথা হয়েছিল সেভাবেই টিকেট কাটা হয়েছে।'

মোখলেসুর রহমান সৌদি আরব থেকে টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পবিত্র হজ নিয়ে কাজ করেন আলমগীর হাসান অথচ তিনি একের পর এক মিথ্যা কথা বলছেন। 'ফিক্সড' টিকেটের বিষয়টি আমাকে জানানো হয়নি। ফেরার একদিন পরে টোকিও টিকেট কাটতে বলেছিলাম, তিনি তা করেননি। আমার এতগুলো টাকা বাড়তি খরচ হলো। আর সৌদি আরবে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে রাখল আমাদের। বাংলাদেশে কি এসব দেখার কেউ নেই! বাংলাদেশের যে এত হাজি হজ করতে এসে মারা গেলেন, ধারণা করি এজেন্সিগুলো অব্যবস্থাপনা ও প্রতারণা এর একটি বড় কারণ? আমি অবাক হয়ে দেখছি, আলমগীর সাহেব কী নির্বিকারভাবে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছেন।'

তারা আজইয়াদ হোটেলে প্রায় ৯০০ বাংলাদেশি হাজি অবস্থান করছেন। এদের প্রায় সবার অবস্থা একই রকম। আরও ৪-৫টি এজেন্সির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন হাজি গুরুতর অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। সেগুলো দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যাচাই করা সম্ভব না হওয়ায় এখানে উল্লেখ করা হলো না।

এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন সৌদি আরবে পবিত্র হজ পালন করছেন। গত ২১ মে থেকে সৌদি আরবে হজযাত্রী নেওয়া শুরু হয়।

এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক হজযাত্রীর খরচ পড়ছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীর ন্যূনতম খরচ পড়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা।

এবার হজযাত্রীরা সৌদি আরবের মক্কায় পৌঁছানোর প্রথম দিনে ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের কারণে ধর্ম মন্ত্রণালয় হজযাত্রী পাঠানো ৮টি এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর যে নোটিশ দেয় সেখানে বলা হয়, ২১ মের ফ্লাইটে ৮টি এজেন্সির হজযাত্রীদের মক্কায় পাঠানো হয়। এজেন্সিগুলোর হজযাত্রীদের ভিসা যে হোটেলের ঠিকানায় করা হয়েছে, সেই হোটেলে তাদের না উঠিয়ে মক্কার বিভিন্ন 'ফিতরা' করা হোটেলে ওঠানোর জন্য পাঠানো হয়। এসব হোটেলে হজযাত্রীদের গ্রহণ করার জন্য এজেন্সির কোনো প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন না। ফলে এই হজযাত্রীরা তাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন। ভিসা অনুসারে হোটেল না হওয়ায় তাদের লাগেজ পৌঁছাতেও সমস্যা হয়।

মক্কার 'তারা আজইয়াদ' হোটেলে অবস্থানরত হাজিরাও এজেন্সির এমন নানাবিধ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছেন।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম ও পরে হজ অধিশাখার উপসচিব মো. মঞ্জুরুল হকের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে ডেইলি স্টার

গতকাল বিকেল থেকে আজ সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত একাধিকবার চেষ্টা করা হয়। প্রত্যেকবারই ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

Comments

The Daily Star  | English
honor smartphone inside

How to build a smartphone

Smartphones feel inevitable in the hand, yet each one begins as a set of drawings, components and hypotheses. The journey from concept to finished device is a carefully sequenced collaboration between design labs, supplier networks and high-throughput assembly lines. In leading electronics hubs across Asia, that journey can take as little as days once a design is frozen and parts are on site.

2h ago