লাইফ সাপোর্টে ‘কুই’ ভাষা

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর একটি কন্দ। মূলত বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে তাদের বসবাস। কন্দ জাতিগোষ্ঠির ভাষার নাম 'কুই'।

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এখানে তাদের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম মানুষ কুই ভাষায় কথা বলে। এই জাতিগোষ্ঠী লোকজনদের মতে, মাত্র চার জন বয়স্ক ব্যক্তি এই ভাষায় কথা বলেন।

যদিও ভারতে কন্দ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভাষাটির প্রচলন আছে।

ভাষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিক (সিল) দেশের ২০টি বিপন্ন ভাষার মধ্যে কন্দসহ চারটি নৃতাত্ত্বিক ভাষার ওপর জরিপ চালায়।

তাদের মতে, এই ভাষা এখন হুমকির মুখে।

সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) তাদের প্রকাশিত বই 'স্লেভ ইন দিস টাইম' বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১২টি উপজেলায়, ৩০টি চা বাগানে প্রায় ৫৩৯টি কন্দ পরিবার বাস করে।

নিজেদের ভাষার চর্চা সম্পর্কে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালীঘাট চা বাগানের বাসিন্দা শ্যামলী কন্দ (৬৫) বলেন, 'আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই আমরা কেবল এই ভাষায় কথা বলি, কিন্তু এখন আর সেটিরও সুযোগ নেই। কারণ তিনি অসুস্থ থাকায় আমাদের বাড়িতে আর আসতে পারেন না। অনেকে এই ভাষাকে বিদ্রুপ করে। তাই আমাদের উড়িয়া বা বাংলা ভাষায় বলতে হয়।'

'আমার নিজের ভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলতে চাই। আমার ভাষায় কথা বলতে পারি না বলে বড় আফসোস হয়,' বলেন শ্যামলী।

সিলের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের কন্দ ভাষাভাষীদের মধ্যে উড়িয়া ভাষাকে মাতৃভাষা বলেন ৭৬ শতাংশ মানুষ। তবে ৪২ শতাংশ মানুষের মধ্যে এর ব্যবহার রয়েছে। কুই ভাষাকে মাতৃভাষা বলেছেন ১১ শতাংশ মানুষ। কিন্তু মাত্র ১ শতাংশের এর চেয়ে কম সংখ্যক কন্দরা এই ভাষায় কথা বলতে পারে। মূলত বয়োজ্যেষ্ঠ এবং মধ্যবয়স্কদের মধ্যে এই ভাষার ব্যবহার দেখা যায়।

কন্দ সম্প্রদায়ের কুই ভাষা সংরক্ষণে চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ (৪৮)।

তিনি বলেন, কুই ভাষার মানুষ হিসেবে আমরা আজকাল পরিচয় সংকটে ভুগছি। আমাদের ভাষা কেউ বোঝে না। আমার কাকা ও পিসিসহ মাত্র চার জন এই ভাষা জানেন। নিজেদের মধ্যেও তারা এখন আঞ্চলিক বা বাংলা ভাষায় কথা বলছে। প্রতি সময় মনে হয় আমার কাকা পিসিরা মারা গেলে আমাদের ভাষাটিও এখানে মারা যাবে।'

তিনি বলেন, 'নতুন প্রজন্ম এই ভাষায় কথা বলে না। আমি সবেমাত্র একটি বা দুটি শব্দ জানি। আমি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম তখন আমার দাদির কাছ থেকে কিছু শব্দ শিখেছিলাম।'

আমার দাদি প্রতি সন্ধ্যায় কন্দের বীরত্বের গল্প, পৌরাণিক কাহিনী, ধাঁধা, ছড়া, মনোলোগ, ফসল কাটার গল্প, ফসল কাটার উত্সব এবং অন্যান্য উত্সব, শিকার এবং লোক ঐতিহ্যের গল্প বলতেন।

শুধু ভাষাই নয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারাও কেউ চর্চা করে না। বিভিন্ন সমস্যার কারণে এই প্রজন্মের অনেকেই নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি জানে না।

ডিগ্রি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সুখেন কন্দ (২৬) বলেন, আমাদের আলাদা সংস্কৃতি কী তা আমি জানি না। আমি আমার পরিবারের সাথে একই ভাষায় (বাংলা ও উড়িয়ার মিশ্রণ) কথা বলি।'

সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টর কর্নেলিউশ টুডু বলেন, 'মানুষ যে ভাষাগুলো কম জানে সেসব ভাষার অবস্থা জানতে আমি এই গবেষণাটি করেছি। আমরা দেখেছি, এই ভাষাটি বিপন্ন। সারা বিশ্বে ভাষার অবস্থা বিবেচনার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নিরিখ হলো 'ফিশম্যান মানদণ্ড'। সেই মানদণ্ডের বিচারে বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

ফিশম্যান মানদণ্ডের পুরো নাম গ্রেডেড ইন্টারজেনারেশনাল ডিসরাপশেন স্কেল (জিআইডিএস)। একটি ভাষার অবস্থা কী, সেটি বোঝাতে এই মানদণ্ডের আটটি স্তর রয়েছে। চতুর্থ স্তরে থাকলেও ভাষাটি বিপন্ন হিসেবে গণ্য হয় না। কিন্তু চারের পরের স্তরে, অর্থাৎ পঞ্চম স্তরে চলে গেলে ওই ভাষা বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়। কন্দদের ভাষা ছয়ের ওপরে। ওই মানদণ্ডের প্রথম স্তরের বিবেচনার বিষয় হলো, ভাষাটি ঊর্ধ্বতন সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় কি হয় না। বাংলাদেশের কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাই সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় না।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

2h ago