চৈত্র সংক্রান্তিতে ঐতিহ্যের খাবার

সংক্রান্তির শিন্নি। ছবি: সংগৃহীত

চৈত্র সংক্রান্তি; অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন। ঠিক যেমন পৌষ মাসের শেষ দিনটি পৌষ বা মকরসংক্রান্তি। প্রতি মাসের শেষ দিনটিই আসলে সংক্রান্তি। তবে চৈত্রসংক্রান্তি বাঙালির জীবনে বিশেষ। কারণ, এটি বাংলা বছর পরিক্রমার শেষ দিন। পরের দিনটিই পয়লা বৈশাখ, অর্থাৎ নতুন বছরের শুরু।

কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, চৈত্রসংক্রান্তি মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে একটি যোগসূত্র ঘটানোর জন্য পালন করা হয়। আর বর্ষ শেষের এই উৎসব উদযাপনেই বাঙালি অভ্যস্ত ছিল দীর্ঘকাল।

এদিকে আবহমান কালের রীতি অনুসারে একেক উৎসবের জন্য একেক রকমের খাবার নির্ধারিত আছে; যা এখানকার কৃষিসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। যে কারণে দেখা যায়, যে ঋতুতে যে উৎসব হয়, সে ঋতুতে যা পাওয়া যায়, তাই হয় সে উৎসবের খাবারের প্রধান উপকরণ।

চৈত্র সংক্রান্তির তেমনই একটি খাবার শাকান্ন। একসময় চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে শাকাহার হতো। বাড়ির গৃহিণীরা চৈত্র সংক্রান্তির সকালেই বাড়ির পার্শ্ববর্তী  জলা, জংলা, ঝোপঝাড় থেকে নানা পদের শাক তুলে আনতেন। মজার ব্যাপার হলো এই শাক কিন্তু আবাদি বা চাষ করা হলে হবে না। হতে হতো অনাবাদী। এমন চৌদ্দ পদের শাক দিয়েই সেদিন দুপুরের আহারের রীতি ছিল।  চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বাড়িতে কোনো মাছ-মাংসের পদের আয়োজন হতো না।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গ্রামের বাড়িতে খাওয়া হতো গমের ছাতু, দই ও পাকা বেল সহযোগে এক বিশেষ শরবত। এদিন বাড়িতে আগত অতিথিদের প্রথমে এই শরবত পরিবেশন করা হতো। আবার সংক্রান্তির দিন গ্রামের হাটে কোনো কোনো দোকানে বিক্রেতারা ক্রেতাদের এই শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এক সময় গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল, গুড় ও দুধ সংগ্রহ করা হতো। সংগৃহীত এসব উপকরণ  নিয়ে গ্রামবাসীরা ছুটতেন গাঁয়ের সবচেয়ে উঁচু গাছের তলে। এক্ষেত্রে তালগাছই বেশি প্রাধান্য পেত। সেই শিন্নি পাক দেখতে তালতলায় হাজির হতেন গ্রামবাসীরা। কালক্রমে এটি পরিচিতি পেয়ে যায় তালতলার শিন্নি নামে। এই শিন্নি পরিবেশন করা হতো কলাপাতায়।

আবার গ্রাম বাংলায় আদিকাল থেকেই চৈত্র সংক্রান্তিতে তিতা খাবার খাওয়ার চল ছিলো। লোকজ বিশ্বাস অনুসারে এর ভেতর দিয়ে বিগত বছরের দুঃখ বেদনা বিসর্জন দেওয়া যায়। এ ধরনের খাবারগুলো হচ্ছে—করলা ভাজা, শুক্ত, নিমপাতা ভাজা, উচ্ছে দিয়ে তিতা ডাল, সজনের চচ্চড়ি। শাকের মধ্যেও কয়েকটি ছিল তিতা স্বাদের। অনেকের বিশ্বাস তিতা খাবার যেহেতু শরীরের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম তাই এই খাবার গ্রহণের মাধ্যমে তারা সারা বছর সুস্থ থাকবেন। 

এছাড়া চৈত্র সংক্রান্তির দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকে ব্রত পালন করেন। এসময় আমিষ নিষিদ্ধ। সাত ধরনের তিতা রান্নায় বেশিরভাগ সময় পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া হয়।

চৈত্র সংক্রান্তির দুপুরে একসময় রান্না হতো কাঁচা কাঁঠাল বা এঁচোড়ের তরকারী। কোথাও শুধু কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে তৈরি হয় এঁচোড়। আবার কোথাও কাঁচা কাঁঠালের সঙ্গে  কুমড়ো, ঝিঙে, উচ্ছে, আলু,  কাঁচা কলা, বরবটি, নারিকেল বাটা দিয়ে তৈরি করা হয় পাঁচন।

বাঙালির উৎসব মানেই বাহারি সব খাবারের আয়োজন। আর খাবারের বাইরে চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজা, নীল পূজা, লোকজ নামাজ, নীল উৎসব, খেজুর ভাঙা উৎসব, শিবের গাজন, গম্ভীরার মতো লোকাচারও থাকে।

সূত্র- বাঙালীর খাদ্যকোষ/ মিলন দত্ত

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia laid to eternal rest

Buried with state honours beside her husband Ziaur Rahman

7h ago