যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই পুনরায় চালু করা হয়েছিল বিমানের নারিতা ফ্লাইট

ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুট চালু করার আগে বাণিজ্যিক ও লাভজনক সম্ভাবনা নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস যথাযথ বাস্তবতা যাচাই করেনি বলে জানিয়েছেন বিমানের একাধিক কর্মকর্তা।

দ্য ডেইলি স্টারকে তারা বলেছেন, সেই কারণেই বিপুল লোকসান হওয়ায় চালুর ২১ মাসের মধ্যেই এ রুটে ফ্লাইট বন্ধ করতে বাধ্য হয় বিমান।

আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দেয়। আর অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা একে 'দুর্ভাগ্যজনক ও আত্মঘাতী' বলে অভিহিত করেন।

বিমান প্রথম ঢাকা-নারিতা রুট চালু করে ১৯৭৯ সালে। ১৯৮১ সালে অস্থায়ীভাবে বন্ধের পর আবার চালু হলেও ২০০৬ সালে টানা লোকসানের কারণে রুটটি আবারও বন্ধ হয়ে যায়। ১৭ বছর পর ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ধুমধাম করে পুনরায় চালু হয় নারিতা ফ্লাইট। যাত্রীরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়, কারণ এতে ভ্রমণের সময় কমে ৬-৭ ঘণ্টায় নেমে আসে এবং দীর্ঘ ট্রানজিট এড়ানো যায়।

তবে উড়োজাহাজ ঘাটতি ও টানা আর্থিক ক্ষতির অজুহাতে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে আবারও নারিতা রুটে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় বিমান। এতে যাত্রীদের তৃতীয় দেশের ট্রানজিটের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে ভ্রমণের সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়ে গেছে।

বিমানের সূত্র জানায়, নারিতার প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে ৯৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। ফ্লাইটে গড়ে ৬৯ শতাংশ আসন পূর্ণ থাকলেও এ রুটে মোট লোকসান দাঁড়ায় ২১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়।

বিমানের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সে সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম ছিলেন নারিতা ফ্লাইট পুনরায় চালুর প্রধান উদ্যোক্তা, যা ওই সময় শেখ হাসিনার সরকারের একটি সাফল্য হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল।

নারিতা রুটে সাড়ে ছয় ঘণ্টা সময়ের ফ্লাইট বিমান পরিচালনা করত বোয়িং ৭৮৭ উড়োজাহাজ দিয়ে, যেখানে আসন সংখ্যা ২৭১। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, প্রায় প্রতিটি ফ্লাইটেই অর্ধেক আসন ফাঁকা থাকত।

ফ্লাইট পুনরায় চালুর সঙ্গে জড়িত বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, তখন বিমানের কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও বাস্তবতা যাচাই ছাড়াই এ রুট চালু করে, বাজারের চাহিদা ও আর্থিক বিশ্লেষণকে উপেক্ষা করে।

তিনি আরও বলেন, যারা দায়ী, বিশেষত সে সময়ের বহর পরিকল্পনা কমিটি, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। কারণ যথাযথ গবেষণা ছাড়াই তারা নারিতা ফ্লাইট চালুর অনুমোদন দিয়েছিল, যার ফলে বিমান বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে।

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিমানের উচিত ক্ষতি কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এছাড়া এ রুট চালু রাখতে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্র্যান্ডিংও প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, বিমানের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশের বিমান চলাচলের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জাপানের মতো একটি প্রধান গন্তব্যে—যেখানে আমাদের বাণিজ্য, পর্যটন ও উল্লেখযোগ্য প্রবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে—ফ্লাইট বন্ধ করা বিমানের দুর্বল ব্যবসায়িক পরিকল্পনার প্রতিফলন।

ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, নারিতা ফ্লাইট শুরুর সময় নেপাল ও কলকাতা থেকে অনেক যাত্রী আসতেন। কারণ নিজেদের দেশ থেকে ভ্রমণের চেয়ে তারা এ রুটকে লাভজনক মনে করতেন। কিন্তু যথাযথ প্রচারণা ও ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে বিমান নেপাল ও কলকাতা থেকে আরও ট্রানজিট যাত্রী আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ঢাকা থেকে একটি বিদেশি গণমাধ্যমে কাজ করেন রাকিব হাসনেত। গত দুই বছরে চারবার বিমানে তিনি টোকিও গেছেন। রাকিব বলেন, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নারিতা রুটকে লাভজনক উদ্যোগে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছে বিমান।

বিমানের তৎকালীন এমডি শফিউল আজিমকে ২০২৪ সালের মে মাসে নির্বাচন কমিশনের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি)। যোগাযোগ করা হলে ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করার অভিযোগ সত্য নয়।

'নারিতা ফ্লাইটকে কেন্দ্র করে আমাদের অগ্রবর্তী পরিকল্পনা ছিল। অল নিপ্পন ও কানাডিয়ান এয়ারলাইনসের সঙ্গে কোড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলস ও কানাডায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। তবে সেই পরিকল্পনাগুলো পরে বাস্তবায়িত হয়নি '

বিমান পরিবহনে কোড শেয়ারিং হলো এমন একটি চুক্তি, যেখানে একটি এয়ারলাইনস অন্য এয়ারলাইনসের পরিচালিত ফ্লাইটের আসন বিক্রি করে, কিন্তু নিজস্ব ফ্লাইট নম্বর ও কোড ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে এয়ারলাইনসগুলো তাদের রুট নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে পারে এবং যাত্রীদের জন্য আরও বেশি গন্তব্যের সুযোগ তৈরি করতে পারে, যদিও তারা নিজেরা সেই ফ্লাইট পরিচালনা না করে।

বিমানের মুখপাত্র এবিএম রওশান কবির বলেন, বিমানের কোনো রুট বাস্তবতা যাচাই ছাড়া চালু বা পুনরায় চালু হয় না। যা বিবেচনায় নারিতা ফ্লাইট পুনরায় চালু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। তাই এ রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
Local gold price hiked

Gold hits all-time high

From tomorrow, each bhori of 22-carat gold will cost Tk 181,487

53m ago