ট্রাম্প-মোদির বন্ধুত্ব ফাঁপা ছিল: মাইকেল কুগেলম্যান

মাইকেল কুগেলম্যান

বাংলাদেশে মাইকেল কুগেলম্যান একটি পরিচিত নাম। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক এবং 'ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনের কলামিস্ট। ওয়াশিংটন ডিসির উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে তিনি কানাডাভিত্তিক এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের একজন সিনিয়র ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারর সঙ্গে কথা বলেন।

দ্য ডেইলি স্টার: ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি উচ্চ শুল্ক এবং বৈদেশিক সাহায্য কমানোর মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলো কি যুক্তরাষ্ট্রের ওপরেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে?

মাইকেল কুগেলম্যান: হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্য অনেক নীতির মতোই এটি একটি বিতর্কিত নীতি। প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হলো, অন্যান্য দেশের উচ্চ শুল্ক কীভাবে মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা তুলে ধরা। প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, পাল্টা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে এমন দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব শুল্ক কমাবে। তবে উদ্বেগ রয়েছে যে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে।

দ্য ডেইলি স্টার: যুক্তরাষ্ট্রে কি এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে?

মাইকেল কুগেলম্যান: বিচ্ছিন্নভাবে এর কিছু লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি আমি। আমি অর্থনীতিবিদ নই, কিন্তু আপনি যদি দোকানে যান, তবে দেখবেন গত কয়েক সপ্তাহে খাবারের দাম বেড়েছে। তবে এই নীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি। আর আমরা জানি না যুক্তরাষ্ট্র কতদিন এই শুল্ক নীতি বহাল রাখবে, কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তিনি যেকোনো সময় তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারেন—যদিও শিগগিরই তেমন কিছুর সম্ভাবনা কম, তবে বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

দ্য ডেইলি স্টার: জুলাই অভ্যুত্থানের আগে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ উত্তেজনা ছিল। নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ, নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা বিধিনিষেধ ছিল। এখন সম্পর্কের গতিপথ কোন দিকে?

মাইকেল কুগেলম্যান: সম্পর্কের গতিপথ নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে, যদিও এটা প্রত্যাশিতই ছিল। বাইডেন প্রশাসনের মেয়াদ যখন শেষ হয়, তখন তাদের মনোযোগ ছিল উন্নয়ন সহযোগিতা এবং সংস্কারের জন্য কারিগরি সহায়তা দেওয়ার ওপর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলগুলো বাংলাদেশ সফর করেছে এবং সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউএসএআইডি ২০২৪ সালের শেষের দিকে একটি নতুন সহায়তা প্যাকেজও ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এরপর ট্রাম্প ফিরে আসায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি উন্নয়ন সহায়তা বা সংস্কারের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেবেন না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মধ্যে ফোনালাপ হয়েছে। তারা বাণিজ্য এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুতরাং, আমরা একটি ভিন্ন ধরনের সম্পর্ক দেখতে যাচ্ছি, যা বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে, যদিও বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সহযোগিতার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হতে পারে, যদিও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান এখনও পরিষ্কার নয়।

দ্য ডেইলি স্টার: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অগ্রাধিকার পাবে?

মাইকেল কুগেলম্যান: না। বাইডেন প্রশাসনের একটি মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি ছিল। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর জোর ছিল। তবে বেশিরভাগ সরকার স্বার্থভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই নীতি খুব জোরালোভাবে গ্রহণ করেছেন। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, যেমন—অধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে তার আগ্রহ কম। তাই, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে যে নির্বাচন হওয়ার কথা, সে বিষয়ে আপনি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগের কথা শুনবেন না। আগের প্রশাসনের সময় আমরা যে ধরনের চাপ দেখেছিলাম, তা এখন আর ঘটবে না। আমি মনে করি, এটি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য বরং সহায়ক হবে। আশা করি, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, কিন্তু এটি আগের মতো দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার কারণ হবে না।

দ্য ডেইলি স্টার: অতীতে ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির মধ্যে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু ট্রাম্প এখন ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছেন।

মাইকেল কুগেলম্যান: ট্রাম্প এবং মোদির মধ্যে ঘনিষ্ঠতাকে হয়তো আমরা বাড়িয়েই দেখেছিলাম। তাদের কিছু নীতিগত বিষয়ে মিল ছিল, কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তারা দুজন খুবই ভিন্ন। ট্রাম্প বহুমেরুকে তেমন সম্মান করেন না, যা ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এ কারণে ট্রাম্প ব্রিকসকে অপছন্দ করেন।

ট্রাম্প প্রশাসন অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং ভারতের মতো ঘনিষ্ঠ অংশীদারদের থেকেও সুবিধা আদায়ের জন্য চাপ দেয়। ভারত শুরুতে কিছু ছাড় দিলেও পরে তাদের কৃষি পণ্যের বাজার উন্মুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণেই দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তি হয়নি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব ভারত ট্রাম্পকে দেয়নি, যেখানে পাকিস্তান নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনিত করেছে। এ কারণেও ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন তিনি।

দ্য ডেইলি স্টার: এখন মোদি ও শি জিনপিং সম্পর্ক উষ্ণ করছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে দেখে?

মাইকেল কুগেলম্যান: ভারত ও চীন গত বছর থেকেই সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। ট্রাম্প শুল্ক আরোপের আগেই তারা সীমান্ত চুক্তি করেছে এবং সরাসরি ফ্লাইট চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি এবং শুল্ক আরোপের বিষয়টি বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নয়াদিল্লির আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও, ভারত ও চীন কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বীই থাকবে, কারণ তাদের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ রয়েছে এবং পাকিস্তান চীনের মিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতের সঙ্গে মূল উদ্বেগের বিষয় হলো শুল্ক এবং রাশিয়া থেকে ভারতের জ্বালানি আমদানি। ট্রাম্প ভারত-চীন সম্পর্ককে সমস্যা হিসেবে দেখবেন কি না, তা নির্ভর করে তার চীন নীতির ওপর। তিনি যদি চীনের সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে চান, তবে হয়তো তিনি এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবেন না।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক হঠাৎ করেই গভীর হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের সফর হচ্ছে, যেমন—পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের হোয়াইট হাউস সফর, যা একটি বিরল সম্মান। ভারতের জন্য এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের এই পুনরুজ্জীবন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনার আরেকটি কারণ।

দ্য ডেইলি স্টার: দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে কী বলবেন?

মাইকেল কুগেলম্যান: আমি মনে করি না অদূর ভবিষ্যতে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়বে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে সার্কের মাধ্যমে আঞ্চলিক ঐক্য সম্ভব নয়। এর পরিবর্তে আমরা উপ-আঞ্চলিক প্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি—ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে বিদ্যুৎ ভাগাভাগির চুক্তি হয়েছে; পাকিস্তান মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে কাজ করছে।

বাংলাদেশের কথা বললে, নীতিগতভাবে একটি জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে তার ভূমিকা পালন করা উচিত, কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল নয়। হাসিনা সরকারের ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাংলাদেশের সক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। এখন বাংলাদেশ হয়তো ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করতে পারে। আদর্শগতভাবে, বাংলাদেশের পরবর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করবে এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখবে।

দ্য ডেইলি স্টার: আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী কী সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন?

মাইকেল কুগেলম্যান: এখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো নয়। অন্যদিকে মিয়ানমারের সংঘাতের কারণে আঞ্চলিত যোগাযোগ প্রকল্পগুলো আটকে আছে। দেশের অর্থনীতি তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এবং এর বহুমুখীকরণ ঘটেনি। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি এবং বেসরকারি খাত বেশ ভঙ্গুর। এ কারণে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এর ভূমিকা শক্তিশালী নয়। সুশাসনের ঘাটতিও আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। এখন পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হলেও নির্বাচনের অনিশ্চয়তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। আশা করা যায়, নির্বাচন স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে।

Comments