বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় আধাসামরিক বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা

বেসামরিক বিমান চলাচলের সব ধরনের নিরাপত্তা তদারকির জন্য একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের দাবি, সংঘবদ্ধ অপরাধ, সাইবার হামলা, ড্রোন হামলা ও বোমা হামলার হুমকি মোকাবিলায় একটি স্বাধীন বাহিনী অপরিহার্য।

মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত প্রস্তাব অনুযায়ী, 'অ্যাভিয়েশন গার্ড বাংলাদেশ (এজিবি)' নামে এই বাহিনীতে থাকবে ৭ হাজার ৬৫০ জন সদস্য। এর জন্য সম্ভাব্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৭৭১ কোটি টাকা।

বর্তমানে দেশের বেসামরিক বিমান চলাচলের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও আনসারের ৯ হাজার ৪ জন সদস্য।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বেবিচকের একটি শাখা 'অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি (অ্যাভসেক)' উড়োজাহাজ, যাত্রী, ক্রু ও বিমানবন্দর অবকাঠামো রক্ষায় নিয়োজিত হলেও অ্যাপ্রন, সীমানা, জ্বালানি ডিপো ও কার্গো পরিবহনের মতো সংবেদনশীল এলাকায় নিরাপত্তা আরও জোরদার করা যেতে পারে।

বিমানবন্দর ও রানওয়ে নিরাপত্তার বাইরেও এজিবি অর্থপাচার প্রতিরোধ, অব্যবহৃত রানওয়ে রক্ষা এবং দুটি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

এই বাহিনী পরিচালনা করবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং এর সদস্যরা মূলত বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই আসবেন। প্রয়োজনে বেসামরিক ব্যক্তি ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাহিনীর ৭০ শতাংশ সদস্য আসবেন বিমানবাহিনী থেকে, বাকিরা হবেন বেসামরিক। দীর্ঘমেয়াদে লক্ষ্য রাখা হয়েছে ৫০-৫০ ভারসাম্যে পৌঁছানো।

বাহিনীর প্রায় সম্পূর্ণ নেতৃত্ব দেবে বিমানবাহিনী—একজন এয়ার ভাইস মার্শাল, দুইজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন, দুইজন উইং কমান্ডার এবং একজন উপসচিব থাকবেন এয়ার ভাইস মার্শালের অধীনে। এর বাইরে দুটি পদ সংরক্ষিত থাকবে সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের জন্য।

গ্রুপ ক্যাপ্টেনরা দেখবেন সচিবালয়, বাজেট ও নীতিমালা সংক্রান্ত কাজ, আর উইং কমান্ডাররা দায়িত্বে থাকবেন সমন্বয়, জনসংযোগ, ঝুঁকি মূল্যায়ন, গবেষণা ও তদন্তের। উপসচিব সামলাবেন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইন বিষয়ক কার্যক্রম।

বাহিনীটি পরিচালিত হবে তিনটি শাখার মাধ্যমে—যার মধ্যে দুটির নেতৃত্ব দেবেন এয়ার কমোডর ও একটি পরিচালনা করবেন একজন অতিরিক্ত বা যুগ্ম সচিব।

২০২৬ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে এজিবি কার্যকর করা হবে।

প্রথম ধাপে মোট পরিকল্পিত সদস্যের অর্ধেক ২ হাজার ১৫০ জন কর্মকর্তাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে নিয়োগ দেওয়া হবে। তারা আসবেন বিমানবাহিনী থেকে। সেইসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হবে। এই ধাপে খরচ হবে ২১৫ কোটি টাকা।

২০২৮ সালে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে মোতায়েন বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা হবে। অন্যদিকে রাজশাহী, সৈয়দপুর, যশোর ও বরিশাল বিমানবন্দরে পরিকল্পিত সদস্যের ৫০ শতাংশ নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ধাপে খরচ হবে ২৫৩ কোটি টাকা।

২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব বিমানবন্দরে এজিবির সদস্যদের পূর্ণাঙ্গভাবে মোতায়েন করা হবে এবং শেষ ধাপে এর জন্য ব্যয় হবে ৩০৩ কোটি টাকা।

যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অতিরিক্ত সচিব আতাউর রহমান খান বলেন, এজিবি গঠন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং এখন কেবল এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'বর্তমানে প্রায় ২০টি সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল ব্যবস্থাপনায় জড়িত। বিমানবাহিনীর বিশ্বাস, যদি একক সংস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করে, তাহলে সমন্বয় অনেক ভালো হবে।'

তিনি আরও বলেন, সরকার খতিয়ে দেখবে যে নতুন বাহিনী গঠন ছাড়াই বিদ্যমান সংস্থাগুলো নিরাপত্তার ঘাটতি পূরণ করতে পারে কিনা।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, এজিবি নিয়ে আলোচনা এখনো মন্ত্রণালয় পর্যায়ে চলছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, কাতার, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দুবাই ও হংকংসহ বেশিরভাগ বড় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বেসামরিক পুলিশ, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও তৃতীয় পক্ষের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম ফ্রান্স—যেখানে এয়ার ট্রান্সপোর্ট জেন্ডারমেরি আংশিকভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, এজিবি গঠনের লক্ষ্যে ৩১ আগস্ট একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটিতে রয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি।

কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এজিবি গঠনের কার্যক্রম কীভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে তার সুপারিশ করতে।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম বৈঠকে কমিটি এজিবির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি।

এদিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে, যেখানে এ ধরনের আধাসামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এজিবির দায়িত্ব বর্তমানে বিমান চলাচল নিরাপত্তা দেখভাল করা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে।

এজিবি এমন প্রথম প্রস্তাব নয়।

গত ১০ মার্চ বেবিচকের নিরাপত্তা বিভাগ 'বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স' নামে একটি নতুন নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের প্রস্তাব জমা দেয়।

ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, বাহিনীতে থাকবে ১০ হাজার ৬৩২ জন সদস্য, যার মধ্যে ৭০ শতাংশ আসবে বিমানবাহিনী থেকে প্রেষণে—অনেকটা এজিবির কাঠামোর মতোই।

বাহিনীটির নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল একজন এয়ার ভাইস মার্শাল বা এয়ার কমোডরের এবং এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯৭ কোটি টাকা।

প্রস্তাব ঘোষণার এক সপ্তাহ পরই বেবিচক কর্মীরা বিমানবন্দরজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন এবং আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মনজুর কবির ভূঁইয়া পরিকল্পনাটি বাতিল করতে বাধ্য হন।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে এয়ারফিল্ড নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণ কে নেবে—এপিবিএন নাকি বিমানবাহিনী—তা নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়।

২০১০ সালের এপ্রিলে জাতীয় গোয়েন্দা সমন্বয় কমিটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম এপিবিএনকে মোতায়েন করে। ২০২২ সালের জুনে বাহিনীটিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরের নিরাপত্তা তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে আরও ছয়টি বিমানবন্দরে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে মোট আড়াই হাজার এপিবিএন সদস্য বিমানবন্দরগুলোতে মোতায়েন রয়েছেন।

বেসামরিক প্রশাসনকে তিন মাসের জন্য সহায়তা দিতে ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অন্যান্য পুলিশ ইউনিটের মতো এপিবিএনেও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এবং তারা দায়িত্ব ছেড়ে চলে যায়। এরপর বিমান বাহিনী বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এপিবিএন আবার তাদের সেই দায়িত্ব ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে দেখতে পায়, সেখানে ইতোমধ্যেই দায়িত্বরত রয়েছেন অন্য কেউ।

গত ২৮ অক্টোবর এপিবিএন অভিযোগ করে, বিমান বাহিনীর নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা বাহিনী ঢাকা বিমানবন্দরে তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ উলটপালট করে ফেলেছে। এর বিষয়ে পরদিন তারা বিমানবন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করে। এই ঘটনার পর উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।

জিডিতে বলা হয়, এপিবিএনের এয়ারসাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার অফিস থেকে সরঞ্জামাদি সরিয়ে ফেলা হয়েছে, অফিসের সাইনবোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের লোগো সরিয়ে 'বিএএফ টাস্ক ফোর্স' লেখা সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে।

বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের নির্দেশে এপিবিএনের মালিকানাধীন ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরাগুলো কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায়।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বেবিচক, পুলিশ সদর দপ্তর ও অ্যাভসেকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখানে হস্তক্ষেপ করেন এবং এর ফলশ্রুতিতে পরদিন এপিবিএন জিডি প্রত্যাহার করে।

এর দুদিন পর এপিবিএন কর্মীরা তাদের পদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশে বাধার মুখে পরলে আবারও উত্তেজনা তৈরি হয়।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন।

সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিমানবন্দরের সব সংস্থা বেবিচকের অধীনে কাজ করবে এবং এপিবিএন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা দায়িত্ব পুনরায় শুরু করবে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক ও পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম সভায় উপস্থিত ছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

1h ago