কুমিরের ঝুঁকি এড়াতে জেলেদের মধ্যে নেই সচেতনতা, প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি

সুন্দরবনে কুমিরের আক্রমণে এক জেলের মৃত্যু স্থানীয় জেলেদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। মঙ্গলবার সকালে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুব্রত মণ্ডল (৩২) কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কুমিরের আক্রমণের শিকার হন। কুমির তাকে টেনে নিয়ে যায় খালে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর অন্য জেলেরা তার মরদেহ পান।
স্থানীয় জেলেরা জানান, সুন্দরবনের দক্ষিণাঞ্চলীয় খাল-নদীতে কুমিরের উপস্থিতি অনেক পুরোনো এবং এসব এলাকায় প্রায়ই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এখনো জেলেদের মধ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। অনেকে সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই কুমিরপ্রবণ এলাকায় মাছ ও কাঁকড়া ধরতে যান। এ ছাড়া, কুমিরের বিপদ থেকে বাঁচার বিষয়ে তাদের মধ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে।
কচুয়া এলাকার জেলে আক্কাস শেখ বলছিলেন, 'আমরা অসহায়। মাছ ধরা ছাড়া আমাদের জীবিকা নেই। ঝুঁকি জানি, কিন্তু কোনো বিকল্প নেই।'
পশুর রিভার ওয়াটারকিপার মো. নূর আলম শেখ বলেন, 'কুমিরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।' তিনি বলেন, 'কুমিরের সংখ্যা নদীতে বাড়ছে, আংশিক কারণ করমজলের প্রজনন কর্মসূচি থেকে কুমির বনে ছাড়া হচ্ছে। তাই বন বিভাগের উচিত জেলেদের জন্য সচেতনতা কর্মসূচি বাড়ানো— কোথায় কুমির বেশি এবং কী কী সাবধানতা নিতে হবে সেসব বিষয়ে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'বিপদ শুধু নদীর ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। জেলেদের নদীতে নামার সময় অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। তবে নৌকায় থাকাও সবসময় নিরাপদ নয়। ক্ষুধার্ত কুমির নৌকা থেকেও মানুষকে আক্রমণ করেছে— এমন ঘটনাও শোনা যায়।'
নূর আলম বলেন, 'আসল সমস্যা হলো নদীর খাদ্যচক্র। নদীতে পর্যাপ্ত মাছ না থাকলে কুমির না খেয়ে থাকে। তখন তারা নৌকায় থাকা মানুষকেও শিকার হিসেবে দেখে। এ ধরনের মর্মান্তিক সংঘাত আসলে খাদ্যচক্রের ভাঙনের ফল। মানুষকে রক্ষা করতে হলে আগে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।'
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবশেষ ঘটনাটি ঘটে করমজলের কাছে একটি সংবেদনশীল এলাকায়। দুর্ভাগ্যজনক এই মৃত্যু এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে ঘটেছে। এ বছর আমাদের বিধিনিষেধের কারণে এলাকা নিরিবিলি ছিল। তাই প্রথমবারের মতো এক কুমির সেখানে ডিম দিয়েছে। ওই জেলে যে স্থানে নামেন, সেটিই ছিল কুমিরের ডিম রক্ষার জায়গা। তিনি যদি নৌকায় বা স্থলে থাকতেন, তাহলে নিরাপদ থাকতেন।'
সাধারণ নিরাপত্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'জেলেদের কুমিরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো পানিতে না নামা। সব কাজ মাছ ধরা নৌকা থেকেই করতে হবে। প্রতিদিন হাজারো জেলে এভাবেই নিরাপদে কাজ করেন। বিপদ আসে তখনই, যখন জেলেরা খালের ভেতর নেমে জাল টানেন। মে মাসে ধানসাগরের কাছে একইভাবে এক নারীও আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।'
সচেতনতামূলক প্রচারণা আরও জোরদার করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা এসব নিয়ম বারবার প্রচার করব। তবে জেলেরা ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন। আসল সমস্যা হলো খালে নেমে মাছ ধরার এই বিপজ্জনক অভ্যাস।'
বন কর্মকর্তা আরও মনে করিয়ে দেন প্রাণীর ভূমিকা সম্পর্কে। 'কুমির হলো জলের অভিভাবক, আর বাঘ হলো স্থলের অভিভাবক। এরা সুন্দরবনের সম্পদকে রক্ষা করে। বাঘ না থাকলে অনেক জায়গা দখল হয়ে যেত চিংড়ি ঘেরে। তাই এসব প্রাণীর অস্তিত্ব বন রক্ষায় অপরিহার্য।'
Comments