‘জলবায়ু কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে নারী ও যুবসমাজকে রাখতে হবে’

বাংলাদেশে কার্যকর জলবায়ু উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ, সামাজিক সমন্বয় ও রূপান্তর প্রয়োজন। আর এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকতে হবে নারী ও তরুণদের।
গতকাল রোববার এক গোলটেবিল বৈঠকে এমন মন্তব্যই করেছেন বক্তারা।
দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে 'জলবায়ু সহনশীলতায় নারী ও তরুণদের ক্ষমতায়ন: নীতিমালা ও অর্থায়নের শূন্যতা পূরণ' শীর্ষক এ বৈঠক যৌথভাবে আয়োজন করে দ্য ডেইলি স্টার ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন।
গ্রিন ভয়েসেস ইনেশিয়েটিভ প্রকল্পের অধীনে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করে নেদারল্যান্ড দূতাবাস।
বৈঠকে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, 'সরকারকে শুধু প্রতিশ্রুতিতে আটকে না থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা বারবার মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতার ঘাটতি এবং বিনিয়োগের অভাবের কথা বলেছি। নারী ও তরুণরা এখন আর শুধু সুবিধাভোগীই নয়, তারা এখন কৃষি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে বাস্তব সমাধান বাতলে দিচ্ছে। এমন অবদানের পরও তাদের পেছনে অর্থায়নের বিশাল ঘাটতি রয়ে গেছে।'
ফারাহ কবির আরও বলেন, 'এই সমস্যা সক্ষমতার নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছার। বাংলাদেশে এখন নারী ও তরুণবান্ধব অর্থায়ন দরকার। একইসঙ্গে জবাবদিহিতা এবং সমাজের প্রাথমিক স্তর থেকে টেকসই জলবায়ু সহনশীলতা গঠনে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।'
বৈঠকে ইউএন উইমেনের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট দিলরুবা হায়দার বলেন, 'জলবায়ু নীতি কার্যকর করতে হলে তথ্যভিত্তিক পদক্ষেপ ও সমন্বয় জোরদার করতে হবে। অগ্রগতি খুবই কম, কিন্তু এ জন্য তো আমরা থেমে যেতে পারি না।'
তিনি আরও বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন, লিঙ্গ সমতা ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসসহ এই বিষয়গুলোর সঙ্গে ২৫টি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট থাকলেও, এগুলো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এর অগ্রগতি নিশ্চিতের জন্য এখন সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শক্তিশালী সমন্বয় প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, 'একইভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণে লিঙ্গভিত্তিক তথ্য সংগ্রহও জরুরি। সমাজে লিঙ্গ সমতার প্রতি আমাদের নিয়মিত দৃষ্টিভঙ্গি যদি না বদলায়, তাহলে কোনো নীতিই শেষ পর্যন্ত টেকসই পরিবর্তন আনতে পারবে না।'
আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, 'বাস্তব পরিবর্তন আনতে হলে আবহাওয়া ও জলবায়ুর জ্ঞানের ঘাটতি দূর করতে হবে। একইসঙ্গে গবেষণা ও নীতির সংশ্লিষ্ট ঘাটতি চিহ্নিত করে সমাধান খুঁজতে হবে।'
তানিয়া হক আরও বলেন, 'তীব্র গরমে নারীদের কাজকর্ম ও শরীরের ওপর নানা ধরনের প্রভাব ফেলে। বৈষম্য যেমন উৎপাদনশীলতা কমায়, তেমনই জাতীয় প্রবৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলে। আমাদের ভুক্তভোগী না হয়ে অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। স্থানীয় জ্ঞানকে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণসহ সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক তথ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।'
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়কারী সোহানুর রহমান বলেন, 'আমি মাঠ পর্যায় থেকে এসেছি। ১০ বছর আগে বরিশালে আমি জলবায়ু আন্দোলন শুরু করেছিলাম। বহুদিন ধরেই আমরা লিঙ্গ সমতা ও সবার অংশগ্রহণের কথা বলছি, কিন্তু এখনো সমতার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। কারণ নারী, তরুণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখনো অভিযোজন ও প্রশমন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন।'
সোহানুর রহমান আরও বলেন, 'শুধু আলোচনার টেবিলে লিঙ্গ ও পরিচয়ের বৈচিত্র্য দেখলে হবে না, বরং প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হতে হবে। আমাদের লিঙ্গ সংবেদনশীল নীতি থেকে লিঙ্গ-রূপান্তরমূলক নীতিতে যেতে হবে, যেখানে পুরুষ ও কৃষকদের অন্তর্ভুক্তি থাকবে। কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া তরুণদের ভূমিকা প্রান্তিক পর্যায়েই পড়ে থাকবে। তাই এখনই সময় নারী ও তরুণদের প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি, সম্পদ ও নেতৃত্ব নিশ্চিত করার।'
বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও জাতিসংঘ শাখার প্রধান একেএম সোহেল বলেন, 'অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া কোনো সরকারই প্রকৃত অর্থে জলবায়ু সহনশীলতা অর্জন করতে পারবে না।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি করেছে। যেমন, নীতিমালা প্রণয়ন, ১১৩টি খাত চিহ্নিতকরণ, এবং জলবায়ু কাঠামোর আওতায় সাত হাজারের বেশি কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে। তবে এখনো সুস্পষ্ট বাজেট বরাদ্দের অভাবে বড় ধরনের আর্থিক ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কার্যকর সম্পৃক্ততায় বাধা দিচ্ছে। এ জন্য আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নির্ভরযোগ্য তথ্য নিশ্চিত করতে হবে, জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিটি ধাপে নারী ও তরুণকেন্দ্রিক কাঠামো সংযুক্ত করতে হবে।'
বৈঠকে 'গ্রিন ভয়েসেস: বাংলাদেশে জলবায়ু কার্যক্রমে নারী ও তরুণদের ক্ষমতায়ন' উদ্যোগের একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সামিরা ইয়াসমিন।
নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করছে বহ্নিশিখা ও দি আর্থ।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ নাফিসা নওরিন চৌধুরী।
আরও বক্তব্য রাখেন দি আর্থের গ্রিন ভয়েসেস প্রকল্পের সমন্বয়কারী শরৎ স্বাধীন, ব্রাইটার্সের চেয়ারম্যান ফারিহা সুলতানা অমি, বহ্নিশিখার পরিচালক সামিনা ইয়াসমিন, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান, ব্র্যাক ক্লাইমেট হাবের সহযোগী পরিচালক মো. গোলাম রাব্বানী, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকর্তা মৌসুমি পারভীন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক বনশ্রী নিয়োগী মিত্রা, গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস কাউন্সিলের বাংলাদেশ প্রধান ফারাহ আনজুম, দ্য ডেইলি স্টারের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কামাল আহমেদ ও দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন ডেইলি স্টারের এনজিও ও বিদেশি মিশন বিভাগের ইনচার্জ মোহাম্মদ তানজিম ফেরদৌস।
Comments