কৈশোর রাঙানো রকিব হাসান

ছবি: সংগৃহীত

আমাদের গ্রামের নাম নিত্যানন্দপুর। অনেকে বর্ধমান নামেও ডাকত। প্রত্যন্ত এলাকা। সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। পাশেই নূরনগর গ্রাম। তারপর ছোট্ট নদী। সেই নদীর নাম কালিন্দী। আর কালিন্দীর ওপারে ভারত। মুরব্বিদের কখনো ভারত বলতে শুনিনি। সবাই বলতেন, ওপার। ওপার মানে ভারত, এপার মানে বাংলাদেশ। নদীর ওপারে ভারতের হিঙলগঞ্জ, সাহেবখালী, লেবুখালী, ভান্ডারখালী, শীতালিয়া, আতাপুর…।

গ্রামের রাস্তা তখনো কাঁচা। বৃষ্টিতে হাঁটু সমান কাঁদা হতো। এতটাই প্রত্যন্ত গ্রাম যে, রাস্তা হলো কয়েকদিন আগে। বিদ্যুতও গেছে খুব বেশি আগে না। সেখানে ঢাকার বই পাওয়া যেত না, পত্রিকা ও ম্যাগাজিন ছিল আরও দুরূহ।

আমরা পাঁচ তারিখের পত্রিকা পেতাম আট তারিখে। তবে ভারতীয় বই পাওয়া যেত। কারণ, ঢাকা ও কলকাতার সঙ্গে দূরত্ব! আমাদের ঢাকা আসতে তখন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা লাগত। অথচ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় কলকাতা যাওয়া যেত। শীর্ষেন্দু, সুনীল ও সমরেশের বই হাতের কাছেই পাওয়া যেত। কিন্তু ঢাকা থেকে প্রকাশিত বই পড়ার সুযোগ খুব কম পেতাম। তাই তখনো রকিব হাসানের সন্ধান আমরা পাইনি!

একসময় একটি এনজিওর সহায়তায় গ্রামের স্কুলে একটা পাঠাগার হলো। সেখানে রাখা হলো বাংলাদেশের বই, পত্রিকা ও ম্যাগাজিন। সবাই লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তেন। বাড়িতে নিয়েও পড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সদস্য হতে হবে। এক মাসের সদস্য ফি ২০টাকা। সেই ২০০৪-০৫ সালের কথা। তখন ২০টাকা মানে অনেক!

একদিন বিকেলে পাঠাগারে গেলাম। তারপর র‌্যাক থেকে একটি বই নিই। নিউজপ্রিন্টে ছাপা, পেপারব্যাক। নাম পুরোটা মনে নেই। তবে রহস্য শব্দটি ছিল। লেখক ছিলেন রকিব হাসান। এক বসাতেই টানা অনেকগুলো পৃষ্ঠা পড়ে ফেলি। একটু পর লাইব্রেরিয়ান বললেন, 'পাঠাগার বন্ধ হয়ে যাবে। এখন বই রেখে দাও। কাল এসে আবার পড়ো।'

অনুরোধ করে বললাম, 'আমি বইটা নিয়ে যাই। কাল ফেরত দিয়ে দেব।'

কিন্তু ওনার সাফ কথা, 'কেবল পাঠাগারের সদস্যরা বই নিতে পারবে।' তিনি কোনোভাবে বই দিলেন না। মন খারাপ করে বাড়িতে যাই। তবে মন পড়ে রইল রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দাতে।

পরদিন স্কুল ছুটি শেষে পাঠাগারে ঢুকি। তারপর আবার বইটা পড়তে শুরু করি। কিন্তু আশপাশে এত চিল্লাচিল্লি যে, মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এই বইটা চুরি করব। তারপর বাসায় নিয়ে নিরিবিলি পড়ব। সুযোগ খুঁজতে থাকি। সাধারণত স্কুল ছুটির পর ভিড় বেশি থাকত। লাইব্রেরিয়ান বাইরে যেতেই লম্বা অঙ্ক খাতার মধ্যে বইটা ঢুকিয়ে দিই। তারপর আস্তে আস্তে কেটে পড়ি। সেদিন রাতে খুব মজা নিয়ে বইটা শেষ করি।

পরে রকিব হাসানের এই বইটা আমার দুই বন্ধু পড়েছিল। এরপর তিনজন তিন গোয়েন্দার বিরাট ভক্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা কেউ সদস্য না। সদস্য হওয়ার টাকাও নেই। বাড়ি থেকেও দিচ্ছে না। তাহলে উপায়? উপায় একটাই তিন গোয়েন্দা চুরি করতে হবে। যত ঝুঁকিই থাকুক এই কাজ করতে হবে।

তারপর পাঠাগার থেকে একের পর এক তিন গোয়েন্দা ও রকিব হাসানের অন্যান্য বই চুরি হতে থাকে। একেক দিন একেক জন চুরি করি আর তিনজন মিলে পড়ি। এভাবে প্রায় ২০ থেকে ২৫টা বই আমরা টানা চুরি করে পড়েছি।

কিন্তু সমস্যা হলো তারপর…। এক বন্ধু বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল। তারপর লাইব্রেরিয়ান তাকে নিয়ে গেল হুজুর স্যারের কাছে। তিনি আমাদের ধর্মীয় ক্লাস নিতেন। তাই আমরা হুজুর স্যার ডাকতাম। খুব মারতেন তিনি। আমার ওই বন্ধুকে সেদিনও খুব পেটালেন। বই চুরির জন্য এভাবে আর কাউকে মার খেতে হয়েছে কিনা জানা নেই!

তবে এত মার খেয়েও বেচারা কোনো লজ্জা পেল না। ওর দাবি ছিল, বইচোর খেতাব পাওয়াটা সম্মানের ব্যাপার। ওর কথা হলো, 'কারো ক্ষতিতো করিনি। কারো টাকা-পয়সা চুরি করিনি। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ বই চুরি করেছেন!'

তবে ওই বন্ধুর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ ও সেদিন আমাদের দুজনের নাম বলেনি। একাই সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়েছিল। অবশ্য পরে আমরা সব বই পাঠাগারে ফেরত দিয়ে দিই।

তারপর নানাভাবে তিন গোয়েন্দা সংগ্রহ করে পড়েছি। শুধু তিন গোয়েন্দা নয়, রকিব হাসানের অনেক বই পড়া হয়েছে। তবে, আর কখনো চুরি করে পড়িনি। কিনে পড়েছি, কিংবা কারো কাছ থেকে ধার করে পড়েছি। তবে যেভাবেই পড়ি না কেন, আমাদের কৈশোরকে অদ্ভুতভাবে রাঙিয়েছিলেন রকিব হাসান।

এই গল্পটা হয়তো কেবল আমাদের নয়, কয়েক প্রজন্মের। এই কয়েক প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছিলেন রকিব হাসান। তৈরি করেছেন লাখো লাখো পাঠক। যারা এখনো বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকে। এভাবে তিনি বেঁচে থাকবেন আরও আরও অনেক প্রজন্ম, পাঠকের ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায়।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia laid to eternal rest

Buried with state honours beside her husband Ziaur Rahman

10h ago