যেমন ছিল রকিব হাসানের কৈশোর

ছবি: সংগৃহীত

তিন গোয়েন্দার সিরিজের লেখক রকিব হাসান তার লেখার মাধ্যমে অন্তত দুই প্রজন্মের বাঙালির কৈশোরকে বইয়ের পাতায় বুঁদ করে রেখেছিলেন। কখনো রহস্য পত্রিকায়, কখনো ক্লাসিক সাহিত্যে, আবার কখনো গোয়েন্দা কাহিনীর মাধ্যমে তিনি স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।

আপন সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালির কৈশোর বর্ণিল করে তোলা রকিব হাসানের কৈশোরও ছিল দুরন্তময় ও প্রাণোচ্ছলপূর্ণ। তৎকালীন ফেনী মহকুমা আর বর্তমানের ফেনী জেলা শহরে কেটেছে রকিব হাসানের শৈশব-কৈশোর। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় রকিব হাসানের লেখা আত্মজীবনী 'আমার কৈশোর'।

সেই আত্মজীবনী থেকে নির্বাচিত ও সংক্ষেপিত কিছু অংশ তুলে ধরা হলো এই লেখায়।

'ছেলেবেলাটা কেটেছে আমার ফেনী শহরে। মাস্টার পাড়ায় থাকতাম, সোনা মিয়া হাজারীদের বাড়িতে। আব্বা সরকারি চাকরি করত। দীর্ঘ বারো বছর ছিলাম আমরা সেখানে। সোনা মিয়া হাজারীর ছেলে ননু, গনু হাজারীর ছেলে কামাল ছিল আমার বাল্যবন্ধু। ওদের সঙ্গে মার্বেল খেলতাম, মাছ ধরতাম, গুলতি নিয়ে বেরিয়ে যেতাম পাখি শিকারে। বাসার কাছেই ছিল বিরাট এক দীঘি। তাতে মাছ ধরতেন আমাদের এক কমন দাদু।'

ফেনীর রাজাঝির দীঘি | ছবি: স্টার

'স্কুল ছুটি থাকলে সারা বিকেলই গিয়ে বসে থাকতাম তাঁর কাছে, আর গল্প শুনতাম। নানা রকম গল্প। দেশ-বিদেশের গল্প। কলকাতা, বার্মা অনেক জায়গায় গিয়েছেন তিনি। তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকার আরও একটি বড় লোভ ছিল, গল্পের বই। কোনমতে ভজিয়ে-ভাজিয়ে একটা বই নেয়া, পড়ার জন্য।'

আমাদের শৈশবকে বর্ণিল করে তোলার সঙ্গী হয়তো ছিল তিন গোয়েন্দা। রকিব হাসানের শৈশবের বর্ণিল নায়কও ছিল একজন। রকিব হাসানের ভাষায় তিনি হলেন ইদ্রিস ভাই।

'স্কুল ছুটি। সম্ভবত দুর্গাপূজা কিংবা গরমের ছুটি হবে, ঠিক মনে নেই। পড়ারও চাপ নেই। সকাল বেলায়ই বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে। খানিকক্ষণ অহেতুক ঘোরাফেরা করলাম দীঘির পাড়ে। কথা বলার কাউকে পেলাম না। ননু, কাশেম, কচি, শওকত, কেউ নেই। হতাশ হয়ে এসে বসলাম দীঘির ঘাটে। যদি কেউ আসে। কেউ এল না। গেল কোথায় আজ ওরা সব? ঘাটে বসে বসে দেখছি, শান বাঁধানো সিঁড়ির কাছে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে শত শত ডানাকাটা মাছ। বেলে মাছগুলো ভালমানুষ সেজে এসে চুপটি করে শুয়ে পড়ছে সিঁড়িতে। মনে হয় কিচ্ছু জানে না। পানিতে হাত ডুবিয়ে চেপে ধরলেও কিছু বলবে না। কিন্তু আমি জানি, ধরতে গেলেই চোখের পলকে সুড়ুৎ করে ছুটে পালাবে। কাজেই সে চেষ্টা করলাম না। কিন্তু মাছগুলো ক্রমশ লোভ দেখাতে লাগল আমাকে। ভাবলাম, যাই, দুপয়সা দিয়ে একটা বড়শি কিনে ছিপ বানিয়ে নিয়ে আসি।'

'ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি প্রায়, এমন সময় সেখানে এসে হাজির ইদ্রিস আলী ওরফে আমাদের অনেকেরই ইদ্রিস ভাই। পড়ালেখা বিশেষ করেনি, খালি বাউন্ডুলেপনা করে বেড়ায়।'

'…ইদ্রিস ভাইকে আমার ভারী পছন্দ। প্রচণ্ড স্বাধীন মনে হয় তাঁকে। যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়াতে পারে, বাধা দেয়ার কেউ নেই।...বেশী ভালো লাগে তার গল্প শুনতে। অনেক ভূতের গল্প জানে সে। শ্মশানের ভূত, তাল আর তেঁতুল গাছের জিন, আন্ধা-পুকুরের মেছো জিন। মোট কথা এমন কোন জিন ভূত নেই যার সঙ্গে ইদ্রিস ভাইয়ের সাক্ষাৎ হয়নি।'

'প্রচণ্ড গরমের দিনে গরম সইতে না পেরে সন্ধের দিকে দীঘির ঘাটে গিয়ে বসেছি একদিন। ওখানে ফুরফুরে বাতাস। বিশাল চাঁদ উঠেছে পুবের আকাশে। জ্যোৎস্নায় ঝিলমিল করছে পানি, দিনের বেলা যা কুচকুচে দেখায় কোনো জাদুর বলে সেটা হয়ে গেছে রুপালি।'

ভূতের গল্প শোনার জন্য চমৎকার পরিবেশ। ইদ্রিস ভাই বসে আছে সেখানে, একা। বায়না ধরলাম, 'ইদ্রিস ভাই একটা ভূতের কিচ্ছা বলেন না ওই যে নান্দু ফকিরের ভূতের কিচ্ছাটা…' মুচকি হাসল ইদ্রিস ভাই। 'ভূতের গল্প শুনবি? তো এই পুরানোটা কেন? দাঁড়া, আজকে একটা মেছোভূতের গল্প শোনাব।' 'মেছোভূত?'
'হ্যাঁ দুলালদের পুকুরের।'
'চমকে গেলাম। ওই পুকুরটার অনেক বদনাম। চারপাশে গাছপালা, শিমুল গাছ আছে অনেক। কালো পানি। রোদের চেয়ে ছায়াই বেশি থাকে। ফলে দেখলেই ভয় ভয় লাগে।'

রসগোল্লা, ইনজেকশন এবং হি হি

'প্রাইমারি পাস করেছি ফেনী প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে। ভীষণ গরমের সময় কিছু দিনের জন্য সকালে ক্লাসের ব্যবস্থা হতো।…সেদিনও স্কুলে গেলাম। গিয়ে শুনি কার জানি কি একটা শুভ সংবাদ আছে, সকল শিক্ষক ছাত্রকে মিষ্টি খাওয়ানো হবে রসগোল্লা।'

হা-পিত্যেশ করে বসে রইলাম কখন আসবে মিষ্টি। সব ছেলেরই আমার মতো অবস্থা। পড়ালেখা আর মাথায় ঢোকে না।

সময় আর পেরোতে চায় না। প্রথমে চারটে ঘণ্টা পড়ল। দ্বিতীয় ঘণ্টারও অর্ধেক কেটে গেল। এই সময় বাইরে থুথু ফেলতে গিয়ে একটা ছেলে দেখল বিরাট  গামলা নিয়ে দপ্তরি আসছে। ছুটে ক্লাসে ঢুকে খবরটা জানিয়ে দিল সে। আর কি ঠেকানো যায়। শুরু হলো প্রচণ্ড হট্টগোল। টেবিল চাপড়ানো, জোরে জোরে কথা আর হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও আমাদেরকে থামাতে না পেরে রেগে গিয়ে স্যার বললেন, 'তোরা কি কখনও মিষ্টি খাসনি!'

ছেলেটা দেখে এসেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেল। তার পরেও মিষ্টি আর আসে না। অপেক্ষাটা আরও অসহনীয় হয়ে উঠল। আসে না কেন? আমাদের পাশের ঘরটাতেও হইচই হচ্ছে। ওটার সামনে দিয়েই আসতে হবে দপ্তরিকে।

'শেষে আর থাকতে না পেরে একটা ছেলে স্যারকে জিজ্ঞেস না করেই বেরিয়ে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এল। জানাল, পাশের ঘরেই মিষ্টি বিতরণ হচ্ছে। দুটো ঘর শেষ করে আসতে আসতে অনেক সময় লেগে গেল তিনজন দপ্তরির। অবশেষে শেষ হলো প্রতীক্ষা। ঘরে ঢুকল মিষ্টির গামলা। তুমুল করতালি আর টেবিল চাপড়ানোর মধ্য দিয়ে মিষ্টিকে স্বাগত জানালাম আমরা।'

…মিষ্টি খাওয়ার হইচই তো শেষ হলো। আরেক ঘণ্টা পড়ল। এই সময় পাশের ঘরে আবার শুরু হলো হট্টগোল। কী ব্যাপার? একটা ছেলে বলল, 'আবার মিষ্টি নাকি?' আরেকজন বলল, 'হতে পারে, তখন কম হয়ে গিয়েছিল বলে আবার এনেছে হয়তো।'

পরক্ষণেই বিকট এক চিৎকার। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছে একটা ছেলে। পড়াতে পড়াতে থমকে গেলেন স্যার। যে ছেলেটা আগের বার মিষ্টি কতদূর এল দেখতে বেরিয়েছিল সে-ই পিছনের দরজা দিয়ে চট করে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই এসেই ঢুকল। চোখমুখ ফ্যাকাসে। ভীষণ ভয় পেয়েছে। ওর নাম কাশেম।

'কী হলো রে?' জিজ্ঞেস করলাম। পিছনের বেঞ্চে বসতাম আমি, স্যারের চোখ এড়িয়ে দুষ্টুমি করার সুবিধে বলে। সেদিনও বসেছিলাম।

'ইনজেকশন!' কেঁদে ফেলবে যেন কাশেম।

'ইনজেকশন? বলিস কী?' আঁতকে উঠল আমার পাশের ছেলেটা।

'হ্যাঁ কলেরার!'…পড়ালেখার বারোটা বাজল আবার। স্যারের কোনো কথাই আর কারও কানে ঢুকল না। সবাই অন্যমনস্ক, অস্থির। আবার প্রতীক্ষার পালা। তখন করেছি মিষ্টির, এখন ইনজেকশনের। তবে প্রথমটা আসতে যতটা দেরি হচ্ছে মনে হয়েছিল, পরেরটার আগমন মনে হলো ততটাই তাড়াতাড়ি।

…আমার বুকের মধ্যে কাঁপছে। আগে কখনো ইনজেকশন দিইনি। কী রকম ব্যথা, জানি না। স্যার আমাদের অবস্থা দেখে বারবার অভয় দিচ্ছেন, 'কিছু না, কিছু না, পিঁপড়ের কামড়। টেরই পাবে না।'

এবং সেটা বোঝানোর জন্য নিজেই শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে এলেন ইনজেকশন নেয়ার জন্য। সূচ ফোটানোর আগে হাসি হাসি ভাব করে তাকিয়ে রইলেন ওটার দিকে। কিন্তু সূচ ফোটানোর সঙ্গে সঙ্গে তার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চেহারা বিকৃত করে ফেলার ভঙ্গি দেখেই আন্দাজ করে ফেললাম, পিঁপড়ের কামড়টা বড় শক্ত কামড়। ভয়টা আরও বেড়ে গেল আমার। মরিয়া হয়ে উঠলাম। কী করা যায়? ইনজেকশন আমি নিতে পারব না। পালাতে হবে যে করেই হোক।

আমি বসেছি জানালার কাছে।…জানালাটার শিক নেই। অনেক বড়, আর অনেকটা উঁচুতে। ওটা ডিঙাতে হলে বেঞ্চের ওপর উঠতে হবে। কয়েকটা ঝুঁকি নিতে হবে তাতে। স্যার দেখে ফেলতে পারেন; দপ্তরি ছুটে আসতে পারে; আমার পাশের ছেলেটা পা ধরে আটকানোর চেষ্টা করতে পারে। শেয়ালগুলোকে ভয় নেই। ওরা ব্যস্ত।

তবে সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার যেটা, তা হলো ওখান থেকে নিচে লাফিয়ে নামা। ওখানটায় কাঁটা ঝোপে ভরা জংলা। জানালার ঠিক নিচে রয়েছে একটা চওড়া ড্রেন। অনেক ঝুঁকির ব্যাপার, তাও ইনজেকশনের চেয়ে ভাল মনে হলো। আরেকটা ছেলেকে চেপে ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কারণ ওই সময়টায় সবার চোখই ওদিকটায় থাকে। যেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাঘ-শেয়ালেরা, বেঞ্চের ওপর উঠে দাঁড়ালাম।

এক লাফে জানালায় উঠে 'যা থাকে কপালে' ভেবে দিলাম লাফ। এক লাফে নর্দমা ডিঙ্গিয়ে পড়লাম ওপাশে। কাটার আঁচড় লাগল দু-এক জায়গায়, কেয়ারই করলাম না। পিছনে হইচই করে উঠল কয়েকজন। ফিরেও তাকালাম না। ঝেড়ে দিলাম দৌড়। আমবাগানের ভিতরে ঢুকে ওপাশে বেরিয়ে একটা মজা পুকুরের পাড় দিয়ে ছুটলাম। নিশ্চিন্ত হলাম এতক্ষণে। আর আমাকে ধরতে পারবে না।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

37m ago