‘তিন গোয়েন্দা’য় রাঙানো সেই কৈশোরে ফিরতে ইচ্ছে হয়

বইটার রঙ চটে গেছে। মলাট বিবর্ণ। নিউজপ্রিন্ট কাগজের লেখাগুলো ফ্যাকাসে। তাকিয়ে আছি ধূসর হয়ে যাওয়া ব্যাককভারের লেখায়। সেখানে ঝাপসা হয়ে আসা কালো কালির অক্ষরে লেখা—

হাল্লো, কিশোর বন্ধুরা— আমি কিশোর পাশা বলছি, আমেরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলস, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি, নাম তিন গোয়েন্দা। আমি বাঙালী। থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান, ব্যায়ামবীর। আমেরিকান নিগ্রো; অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা...

অক্ষরগুলো আরও ঝাপসা হয়ে আসছিলো। কান্না পাচ্ছিলো কিনা জানি না। তবে আমার চোখের ভেতর ভেসে উঠছিল বহু বহু বছর আগের এক দৃশ্য। বুকের ভেতর জেগে উঠছিল চিনচিনে এক ব্যথা। তখন বইটি ঝকঝকে ছিলো। লেখাগুলো স্পষ্ট ছিলো। অবিকল আমার রঙিন কৈশোরের মতো।  

গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো, তখন হারিকেনের আধো আলোয় বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকতো টিনটিনে এক কিশোর ছেলে। বাইরে একটানা ঝিঝি পোকা ডাকতো। টিনের চালে টুপটাপ শব্দে ঝরে পড়তো শিশির। দূর কোথাও থেকে ভেসে আসতো শেয়ালের ডাক। অন্ধকারের বুক চিরে হঠাৎ হঠাৎ বিউগলের মতো বেজে উঠতো নাম না জানা কোনো প্রাণীর করুণ কণ্ঠস্বর। কিন্তু বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকা ওই কিশোর ছেলেটিকে সেসবের কিছুই বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারতো না। বরং তাকে দেখে মনে হতো, নিমগ্ন প্রার্থনায় বুঝি নিজেকে আদ্যোপান্ত সমর্পণ করে দিয়েছে সে। 

তার চোখের পলক পড়ছে না। নিঃশ্বাস আটকে আছে। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় গা শিউরে ওঠা কোনো এক রোমাঞ্চকর রহস্য উদঘাটনে সে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ওই ছোট্ট খুপরি ঘরের জানালার বাইরে হাজার হাজার মাইল দূরের এক শহরে। 

সেই শহরের নাম লসএন্জেলস। 

সেখানে রকি বীচ নামে এক জায়গা আছে। আছে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের লোহালক্করের জঞ্জালের নিচে এক মোবাইল হোম। তাতে আছে তিন অচেনা কিশোরের অদ্ভুত ঘোরের এক জগৎ। সেই জগতের রুদ্ধশ্বাস বিচিত্র সব ঘটনা। 

খুপরি ঘরের অন্ধকারে বুঁদ হয়ে থাকা সেই কিশোর ছেলেটি ওই জগতের অনেক শব্দই বোঝে না। অনেক জিনিসপত্রের নামই কখনো শোনেনি। কিন্তু তারপরও সেই বইয়ের কালো কালির অক্ষরে তার চোখজোড়া নির্নিমেষ গেঁথে থাকে। মুহূর্তের জন্যও সরে না। যেন  হিপনোটাইজড হয়ে গেছে সে। এই শব্দটাও তার কাছে অচেনাই ছিলো।  কিন্তু ওই বই তার চোখের সামনে একের পর এক খুলে দিতে থাকে অদ্ভুত বিস্ময়কর সব জানা-অজানার জগত। আস্বাদন করাতে থাকে অদেখা ভুবনের রঙ, রস, রূপ ও গব্ধ। শেখাতে থাকে বিচিত্র সব বিষয়। উন্মুক্ত করতে থাকে অসংখ্য রুদ্ধ ভাবনার দুয়ার, অজানা শব্দের অর্থ, ভাবনার ভুবন।

গাঁয়ের  কাঁচা মাটির থকথকে যে রাস্তায় কখনো  তিন চাকার ভ্যানগাড়িও চলে না, একখানা মোটর সাইকেল দেখলেও লোকের উৎসব লেগে যায়, সেখানে, সেই গাঁয়েরই ওই বই পাগল কিশোর  ছেলেটি কিনা বইয়ের পাতায় ডুবে ডুবে ঘুরে আসতে থাকে  আমেরিকায়, রোলস রয়েস গাড়িতে। 

হোগলা পাতার মাদুর আর মাটির সানকিতে  ভাত খেতে বসে বিস্বাদ তরকারি দেখে সে মাকে জিজ্ঞেস করে, 'কী দিয়ে ভাত খাবো মা?' 
মা জবাব দেন, 'হাত দিয়ে আর মুখ দিয়ে'।

সেই ছেলেটিই কিনা দিব্যি ওই বইয়ের পাতায় ডুবে গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো শব্দে, বাক্যে কল্পনার চোখে চেখে দেখে এপল পাই, মাংস ভাজা, বার্গার কিংবা ফ্রুট কেক! যদিও এর আগে এসবের নামও কখনো শোনেনি সে। সেই তার প্রথম পরিচয় ওই বইয়ের পাতায়। 

আরও কত কত কিছু যে জানা হয় তার! বোঝা হয় আরও কত কত কিছু। ওই বই তার কল্পনার চোখের সামনে একে একে খুলে দিতে থাকে অচেনা সব পৃথিবীর বন্ধ দরোজা। সেই দরোজার নাম ভাবনার ভুবন। আর সেই ভাবনার ভুবন খুলে দেয়া বইয়ের নাম তিন গোয়েন্দা সিরিজ। লেখক রকিব হাসান। 

ছেলেটির অবশ্য ওই লেখককে লেখক মনে হয় না। মনে হয় কল্পলোকের গল্পের জাদুকর। নিশ্চয়ই জাদুর কাঠি আছে হাতে। আর তাই তিনি লিখতে শুরু করলেই সেই জাদুর কাঠি হয়ে যায় জাদুর কলম। আর সেই কলম ছড়াতে থাকে আশ্চর্য জাদুকরী সব সম্মোহন। সেই সম্মোহন এই সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের এক দেশের এক পাড়াগাঁয়ের কিশোরকেও কীভাবে যেন সম্মোহিত করে রাখে আমেরিকার রকি বীচের পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের লোহালক্করের জঞ্জালের নিচের মোবাইল হোমে হেডকোয়ার্টার বানানো তিন কিশোরের রোমাঞ্চকর রহস্য গল্পের কাল্পনিক জগতে!

কী আশ্চর্য, বহু বহু বছর আগে- সেই প্রত্যন্ত গাঁয়ের ওই বই পাগল কিশোর ছেলেটিই ছিলাম আমি! আর আমার সেই কল্পনার জগত অপার আলোয় উদ্ভাসিত করে আস্ত এক আকাশ তৈরি করে দেয়া মানুষটিই ছিলেন রকিব হাসান। দ্যা ম্যাজিক ম্যান। দ্যা ম্যাজিকাল ম্যান। 

ওই লেখক তাই জাদুকরই। তার জাদু মন্ত্রবলে খুপরি ঘরের সেই বই পাগল ছেলেটিও তাই তার কল্পনার পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে উড়ে উড়ে চলে যায় সাড়ে সাত হাজার মাইল দূরের প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের রকি বীচে। সেখান থেকে হলিউড মাত্র কয়েক মাইল দূরে...!

কী আশ্চর্য! চির অদেখা, অজানা, অচেনা সেই শহরটাকেই ছেলেটির হঠাৎ ভীষণ চেনা মনে হয়। নিজের প্রিয় বন্ধুর মতোন আপন মনে হয় কোঁকড়া চুলের ঠোঁটে চিমটি কাটা কিশোর, বইয়ের পোকা রবিন, আর কথায় কথায় 'খাইছে' বলা মুসাকেও। 

এদের কাউকেই কখনো দেখেনি সে। কিন্তু তারপরও তারা প্রত্যেকেই ওই জাদুকরের জাদু-কলমের জাদুতে হয়ে উঠতে  থাকে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। প্রিয় সহচর। কাছের মানুষ। আর সে নিজেও যেন হয়ে উঠতে থাকে তাদেরই একজন। 

ফলে তাদের সঙ্গে সে দিনরাত ঘুরে বেড়াতে থাকে 'ভীষণ অরণ্য', 'জলদস্যুর দ্বীপ', 'ভূতুড়ে সুড়ঙ্গ' থেকে শুরু করে 'অথৈ সাগর' কঙ্কাল দ্বীপ সহ আরও কত কত জায়গায়!  সেসব জায়গায় সে খুঁজে বেড়াতে থাকে 'হারানো তিমি', 'জলদস্যুর মোহর', 'কাকাতুয়া রহস্য', 'হারানো উপত্যকা' থেকে শুরু করে 'পুরনো শত্রু', 'গোলাপি মুক্তো' সহ আরও কত কী!

কী আশ্চর্য, বহু বহু বছর আগে- সেই প্রত্যন্ত গাঁয়ের ওই বই পাগল কিশোর ছেলেটিই ছিলাম আমি! আর আমার সেই কল্পনার জগত অপার আলোয় উদ্ভাসিত করে আস্ত এক আকাশ তৈরি করে দেয়া মানুষটি ছিলেন রকিব হাসান। দ্যা ম্যাজিক ম্যান। দ্যা ম্যাজিকাল ম্যান। 

আজ তিনি নেই! সত্যি সত্যিই কি নেই? খবরটা শোনার পর স্তব্ধ হয়েছিলাম দীর্ঘ সময়। তারপর শেল্ফ খুঁজে তিন গোয়েন্দার ক'খানা বই বের করে ধুলো ঝাড়লাম। তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ। দীর্ঘসময়। তারপর হটাত কেমন কান্না পেতে লাগল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো।

এই আলো ঝলমলে শহর, এই ঝা চকচকে চারধার, এই চকমকি জীবম, এই অবিরাম ছুটে চলা, এইসব ছেড়ে আমার হঠাৎ সেই কৈশোরে  ফিরে যেতে ইচ্ছে হতে লাগলো। রকিব হাসানে রাঙানো কৈশোরে । তিন গোয়েন্দায় ঘোরগ্রস্ত কৈশোরে। 

সেই ঝিঁঝিঁ ডাকা রাতের শিশিরের শব্দে। সেই গহীন রাতের অন্ধকারের নৈঃশব্দ্যে। সেই বুঁদ হয়ে থাকা বইয়ের পাতায়। যেখানে কিশোর আছে, মুসা আছে, রবিন আছে। আর আছে আমার সেই প্রজাপতির ডানার মতন রঙিন সব অনুভবের কৈশোর। সেই কৈশোরে আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে হতে লাগলো জিনা, রাফি, টেরিয়ার ডয়েল ওরফে শুটকি টেরির কাছেও। ফগর‍্যাম্পারকট, বোরিস-রোভার, ওমর শরিফ, ডেভিস ক্রিস্টোফার কিংবা বিশাল বপুর পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের কাছেও। ফিরে যেতে ইচ্ছে হতে লাগলো রাশেদ পাশা ও মেরি চাচীর কাছে। আচ্ছা, কোথায় আছে এখন তারা? কেমন আছে? রকিব হাসানের সাথে সাথে কি তারাও উধাক হয়ে গেলো?

কেউ কি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই তিন গোয়েন্দায় রাঙানো কৈশোরের কাছে? ফিরিয়ে দেবে আমার সেই জাদুর কাঠির কলম হাতের জাদুকরকে? জানি দেবে না। তবুও কেবল সেই জাদুকরী ঘোরের তিন গোয়েন্দায় রাঙানো কৈশোরে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়।

Comments