অমর রকিব হাসান, চির তরুণ তিন গোয়েন্দা

তিন গোয়েন্দা খ্যত রকিব হাসান। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
তিন গোয়েন্দা খ্যত রকিব হাসান। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

আমার দাদু, চাচা ও ফুফুরা থাকতেন ইউনিভার্সিটি স্টাফ কোয়ার্টারে। আব্বা প্রবাস থেকে দেশে ফেরার পর আমরা কিছুদিন সেখানেই থেকেছি। ওই বাসায় বেশ বড়সড় একটি বারান্দা ছিল। একদিন দুপুরে হঠাৎ করেই ওই বারান্দায় একটি বইয়ের আলমারির সন্ধান পেলাম।সেখানে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। 

সেখানে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় শ'খানিক বই ছিল। টিনটিন-অ্যাস্টেরিক্সের ইংরেজি কমিক্স, হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার, শরত-বঙ্কিমের দাঁতভাঙা কয়েকটি বই আর সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা সিরিজের অনেকগুলো বইয়ের কথা মনে পড়ছে।

কী কারণ, এখন আর মনে নেই। তবে নানামুখী বইয়ের সংগ্রহের মাঝে রকিব হাসানের লেখা কাকাতুয়া রহস্য নামের বইটি আমাকে খুব আকৃষ্ট করল। শুরু করলাম পড়া। বারবার বলা যায় কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সত্য একটি কথা হলো—বাকিটা ইতিহাস।

তিন গোয়েন্দার বই কাকাতুয়া রহস্য। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
তিন গোয়েন্দার বই কাকাতুয়া রহস্য। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

এক দুপুরেই অনেকগুলো পাতা পড়ে ফেললাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কিশোর পাশা, মুসা আমান, রবিন মিলফোর্ড, শুটকি টেরি, জিনা পার্কার ও রাফিয়ান আমার প্রিয় চরিত্র হয়ে গেল। গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম একের পর এক।

ওই আলমারিতে সম্ভবত ৫-১০টা বই ছিল তিন গোয়েন্দা সিরিজের। ছিনতাই, রুপালি মাকড়সা, ভীষণ অরণ্য ১ ও ২ এর কথা এখন মনে পড়ছে। মূলত, সিরিজের শুরুর দিকের কিছু বই সেখানে ছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই সবগুলো পড়ে ফেললাম।

এরপর কাজিন, চাচা, মামা, বন্ধু—যার কাছে যে বই পেতাম, সেটাই পড়তাম। অল্প সময়ের মধ্যে সিরিজটির সব বই পড়া হয়ে গেল। এরপর প্রতি মাসে অপেক্ষায় থাকতাম নতুন বইয়ে। টিফিনের টাকা জমিয়ে সেটা কেনার চেষ্টা করতাম।

আমার মতো আরও অনেকেরই শৈশবের বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল তিন গোয়েন্দা।

সে সময় এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত না, যে কল্পনার জগতে গোপন প্রবেশপথ লাল কুকুর চার বা সবুজ ফটক তিন দিয়ে পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে একবার হলেও ঢুঁ মারেনি। ছোটরা যেমন পড়ত, বড়রাও পড়ত।

আমি, আমার খালাতো ভাই আর ছোট মামা মিলে আমাদের নিজস্ব তিন গোয়েন্দা গঠন করেছিলাম। কাগজে কলমে একটা পরিচয়পত্রের ডিজাইনও করেছিলাম। আশা ছিল, ছাপিয়ে ফেলব। তবে সেটা আর কখনোই করা হয়নি।

তিন গোয়েন্দার একটি বইয়ের কভার। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
তিন গোয়েন্দার একটি বইয়ের কভার। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

বইয়ের তিন গোয়েন্দার মতো আমরাও একেকজন একেক রঙের চক সঙ্গে রাখার প্ল্যান করি। কিন্তু সে সময় দোকানে সাদা চক ছাড়া অন্য চক পাওয়া যেত না বললেই চলে। তাই সাদা চকেই ভরসা রাখতে হতো ।

আমরা নিজেরা নিজেরা রহস্য তৈরি করে সমাধানের চেষ্টা করতাম। একবার বাসায় খাওয়ার জন্য আনা কয়েকটা মুরগী হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই মরে গেল। আমরা সেটাকে 'কেস' হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্তও করেছিলাম। প্রাথমিক ধারণা ছিল 'পাশের বাসার বেয়াদব লোকটা' বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে মুরগীগুলোকে।

আরেকবার ফ্রিজ থেকে খাবার চুরি হলো। সে সময় আমাদের তদন্ত আর জেরা খুনের মামলার তদন্তকেও হার মানিয়েছিল। বাসার বড়রা মুখ টিপে হাসতেন, কিন্তু কখনো আমাদের এই 'উদ্যোগ' নিয়ে হাসাহাসি করেননি। কারণ তারাও তিন গোয়েন্দার 'ক্রেইজ' সম্পর্কে জানতেন।

সে সময় ভাবতাম, কোনো একদিন চলে যাব যুক্তরাষ্ট্রে। রকি বিচ খুঁজে বের করে কিশোর-মুসা-রবিনের বাসা দেখে আসব।

কিংবা পরিচালক ক্রিস্টোফার ডেভিসের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার ব্যাপারটা। বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে রোলস রয়েস গাড়িটা নিয়ে আসা। রবিন মিলফোর্ডের সঙ্গে লাইব্রেরিতে যাওয়া। কোনো একটি বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা করা। লাইব্রেরিতে যেয়ে যে গবেষণা করা যায়, এ ব্যাপারটাই জেনেছিলাম তিন গোয়েন্দার কাছ থেকে।

আফ্রিকান আমেরিকান মুসা আমানের প্রাণবন্ত হাসি। কিশোর পাশার এলোমেলো কোঁকড়া চুল দেখে মেরি চাচির চোখ রাঙ্গানি।

চোখ বন্ধ করলেই যেন সব দেখতে পেতাম।

সেবা প্রকাশনীর অনলাইন স্টোরে তিন গোয়েন্দার বই। ছবি: স্ক্রিণশট
সেবা প্রকাশনীর অনলাইন স্টোরে তিন গোয়েন্দার বই। ছবি: স্ক্রিণশট

তিন গোয়েন্দায় এক ধরনের 'অফ লাইন' সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও বর্ণনা ছিল। 'ভুত থেকে ভুতে'—এই প্রক্রিয়ায় সবাই সবার পরিচিত মানুষদের ফোন করে কোনো একটা তথ্য জানতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই তথ্য পাওয়া যায়, এভাবে প্রত্যেকে তাদের পরিচিত জনদের কাছে ফোন করতে থাকত।

এখন এসব ভাবলে হাসি পায়। আবার ভালোও লাগে। এখনকার মতো স্মার্টফোন আর ডিভাইসে বন্দী থাকেনি আমাদের শৈশব। হাতে বই ছিল, মনে ছিল কল্পনা।

অনেকে বলবেন, রকিব হাসান আদতে কোনো লেখকই নন—তিনি একজন অনুবাদক মাত্র। বিদেশি লেখাকে বাংলাদেশি ফ্লেভার দিয়ে লিখেছেন। চুরি-চামারি করেছেন। তার জীবদ্দশায় অনেকে এসব কথা বলেছে, প্রয়াণের পর আরও বেশি করে বলবে।

কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। এসব অভিযোগ আংশিকভাবে সত্য।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, তিনি আমার মতো হাজারো বাংলাদেশি শিশু-কিশোর-কিশোরী-তরুণ-তরুণীর মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলেছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর অনেক লেখক বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড পান। কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক খেতাব না পেয়েও রকিব হাসানের অবদান তাদের অনেকের থেকে অনেক বেশি।

সেবা প্রকাশনীর প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন আর রকিব হাসান যৌথভাবে যত মানুষকে বই পড়া শিখিয়েছেন, তাদের সঙ্গে একমাত্র তুলনা হতে পারে হুমায়ুন আহমেদ ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালের।

একটা জাতির জন্য পড়ার অভ্যাস কত জরুরি, তা আমরা আজকের দিনে টের পাই। ২/৩ লাইনের বেশি কেউ পড়তে চায় না। পড়ে না, রিলস দেখে। বড় লেখা দেখলে টিএলডিআর লিখে চলে যায়। আরও কত কি। সে আলোচনা এই লেখার গণ্ডির বাইরে।

রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

অনেকদিন ধরেই শুনছিলাম রকিব হাসান অসুস্থ। কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে চলে যাবেন, এটা ভাবিনি। আমার মতো অসংখ্য লেখক, অনুবাদক, সাংবাদিককে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন রকিব হাসান। আজীবন। বিনিময়ে কিছুই চাননি।

বাংলা সাহিত্যে রকিব হাসানের অবদান অনস্বীকার্য। হয়তো কখনোই তিনি আনুষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি পাবেন না। কিন্তু আমার আপনার মতো হাজারো পাঠকের মনে স্থায়ী আসন গড়ে চিরজীবন তিনি বেঁচে থাকবেন—তার কাজের মাধ্যমে।

একই ভাবে কিশোর, মুসা আর রবিনেরও বয়স কোনোদিন বাড়বে না। যুগে যুগে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের পাঠকের কাছে চিরতরুণ থাকবে তারা। 

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

1h ago