গণতন্ত্রের হৃৎস্পন্দন সংসদের পুনরুজ্জীবন

রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত জুলাই সনদ বাংলাদেশের সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে একগুচ্ছ সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। বহুদিন ধরে দুর্বল অবস্থায় থাকা সংসদ নির্বাহী বিভাগের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ হিসেবে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
নতুন প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, শক্তিশালী বিরোধী দল, প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো সংসদকে কার্যকর করা এবং সব গণতান্ত্রিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
বিরোধী দলকে শত্রু হিসেবে দেখার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। বিরোধী দল গণতন্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেহেতু আমরা ওয়েস্টমিনিস্টার ধাঁচের ব্যবস্থা অনুসরণ করছি, তাই আমাদের মনোযোগ থাকতে হবে সংসদে।'
বর্তমানে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব অনেক বেশি। এটা সীমিত করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আলী রীয়াজ বলেন, 'বিরোধী দলকে শত্রু হিসেবে দেখার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। বিরোধী দল গণতন্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।'
ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে থাকা সংসদ গঠনমূলক আলোচনাকারী সংস্থার চেয়ে বরং সরকারপক্ষের নেতার ইচ্ছার আনুষ্ঠানিক অনুমোদনদাতা সংস্থা হয়ে ওঠে।
বহুবার সংসদে কোনো অর্থবহ বিতর্ক ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যে বিল পাস হয়েছে, যেখানে সংসদ সদস্যরা কেবল পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। সংসদীয় কার্যক্রম প্রায়শই ছিল বিষয়বস্তুহীন, ফলে অধিবেশনগুলো রূপ পেয়েছে কেবল আনুষ্ঠানিকতায়।
পরপর ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো একতরফাভাবে দমনমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এর ফলে স্বেচ্ছাচারী আইন প্রণয়ন ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ হয়েছে।
এর দুটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী এবং ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী।
এ ছাড়া, এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর—বিশেষ করে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর—স্বার্থ যথাযথভাবে প্রতিফলিত করতে পারেনি।
সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ ব্যবসায়িক স্বার্থে জড়িত বা প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন, যা জনসেবা ও ব্যক্তিস্বার্থ একেবারে মিশিয়ে ফেলেছে। নীতি পর্যালোচনা বা জনস্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে অনেক এমপি সংসদে দলীয় নেতার প্রশংসায় ব্যস্ত ছিলেন। ফলে জবাবদিহিতার বদলে সংসদ পরিণত হয়েছে আনুগত্য প্রদর্শনের মঞ্চে।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে বিরোধী দল প্রায়শই সংসদ বর্জন করেছে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে কার্যত সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। তারা খুব কম ক্ষেত্রেই কার্যকরী বিরোধিতা করেছে।
তবে এসবই পরিবর্তন হতে পারে।

নতুন কী আসছে?
রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে, ৩০০ আসনের নিম্নকক্ষের পাশাপাশি ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ থাকবে। উচ্চকক্ষের সদস্যরা সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। নিম্নকক্ষের সদস্যরা বর্তমান ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন।
উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মানদণ্ড নিম্নকক্ষের মতোই হবে। উচ্চকক্ষের মেয়াদ শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর। তবে নিম্নকক্ষ ভেঙে গেলে উচ্চকক্ষও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকার সঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থীদের তালিকাও প্রকাশ করতে হবে। প্রার্থীদের অন্তত ১০ শতাংশ নারী হতে হবে।
Comments