বিমানবন্দরের আগুন সামনে আনল রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার চরম চিত্র

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমাবিহীন কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ড সরকারি স্থাপনা জুড়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় গভীর এবং বিপজ্জনক অবহেলার চিত্র উন্মোচন করেছে।
সাধারণ বিমা করপোরেশনের নথি অনুযায়ী, দেশের মাত্র ৮৬টি সরকারি স্থাপনার বিমা করা করা আছে। তবে দেশে কি পয়েন্ট ইনস্টলেশনের (কেপিআই) সংখ্যা ৫৮৭টি। সেই হিসাবে মাত্র ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ স্থাপনা বিমার আওতায় আছে।
এই বিমাবিহীন কেপিআইগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দরের মতো কৌশলগত জাতীয় সম্পদ।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন বঙ্গভবন, গণভবন (যা এখন জুলাই অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরিত হচ্ছে), জাতীয় সংসদ ভবন, সচিবালয়, বিটিভি ভবন, বিমানবন্দর ও কারাগারও ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
বিমা কভারেজ না থাকায় অগ্নিকাণ্ড, নাশকতা বা দুর্ঘটনার মতো দুর্যোগে সৃষ্ট ক্ষতির দায় শেষ পর্যন্ত বহন করতে হয় জনগণের করের টাকায়।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, সরকার যদি সরকারি সম্পদের জন্য বাধ্যতামূলক বিমা ব্যবস্থা না নেয়, তবে এ ধরনের প্রতিরোধযোগ্য আর্থিক বিপর্যয় জনসাধারণের তহবিল নিঃশেষ করে দেবে।
সাধারণ বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, 'বাধ্যতামূলক বিধান না থাকায় বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সম্পদের বিমা করতে আগ্রহ বোধ করে না।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়াম খরচের কারণে বিমা এড়িয়ে চলে। অথচ আজকের একটি ছোট প্রিমিয়াম আগামীর বিশাল আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে। সরকার যদি বিশেষ করে উচ্চমূল্যের অবকাঠামোর জন্য বিমা বাধ্যতামূলক না করে, তবে এই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো বিমা কোম্পানির সঙ্গে আলাদা করে বন্দরের জন্য বিমা করা হয়নি, কারণ এতে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে হয়।'
তিনি বলেন, 'আমাদের একটি স্ব-বিমা তহবিল রয়েছে, যেখানে লাভের একটি অংশ নিয়মিত বরাদ্দ করা হয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, সেই তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। শুরু থেকেই এটি প্রচলিত নিয়ম।'
আগুনে বেরিয়ে এলো অন্তঃসারশূন্যতা
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সের আমদানি অংশে লাগা আগুনে গুদামে মজুত আমদানি পণ্য পুড়ে গেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের ধারণা, মোট ক্ষয়ক্ষতি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষতি কেবল আগুনে পুড়ে যাওয়া পণ্যের আমদানি মূল্যেই সীমাবদ্ধ, এমনটি নয়।
এই অগ্নিকাণ্ডের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়বে রপ্তানিমুখী পোশাক ও ওষুধ শিল্পে, পাশাপাশি দেশীয় বাজারের ব্যবসাগুলোর ওপরও।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) পরস্পরের ওপর এই বলে দায় চাপাচ্ছে যে, কার্গো কমপ্লেক্সটি বিমাহীন ছিল।
বেবিচক সদস্য (এটিএম) এয়ার কমোডর নূর-এ-আলম বলেন, 'এই স্থান ও ভবন বেবিচকের মালিকানাধীন, তবে আমরা সেটি বিমানের কাছে ভাড়া দিয়েছি। বিমান তাদের প্রয়োজনে ভবনটি ব্যবহার করে।'
তিনি স্বীকার করেন, বেবিচক এই স্থাপনাটির বিমা করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
বিমান বাংলাদেশের কার্গো পরিচালক শাকিল মেরাজ বলেন, 'আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের মালিক বেবিচক। বিমান অবকাঠামোটির কোনো বিমা করেনি।'
উদাসীনতা
ক্ষতিপূরণ ছাড়াই রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতির ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের কারণে ঢাকা মেট্রো রেলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।
অবকাঠামোর বিমা না থাকায় সরকার কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকার ২০২৩ সালে সব সরকারি ও বেসরকারি ভবনের জন্য বিমা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিয়েছিল এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আইডিআরএকে সেই অনুযায়ী নির্দেশ দিয়েছিল।
কিন্তু পরিকল্পনাটি স্থগিত হয়ে গেছে।
আইডিআরএর মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, '২০২৫ সালের খসড়া বিমা নীতিতে সরকারি ও বেসরকারি ভবনের বিমাকরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।'
আইডিআরএর আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ২০২৩ সালে সরকারি সম্পদের জন্য একটি বিশেষ বিমা পণ্য তৈরি করা হয়েছিল।
আইডিআরএ বিল্ডিং কোড সংশোধনেরও সুপারিশ করেছে।
বাংলাদেশ বিমা সমিতির প্রথম সহ-সভাপতি আদিবা রহমান বলেন, 'বারবার সরকারি নির্দেশ সত্ত্বেও সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ভবনকে বাধ্যতামূলক বীমার আওতায় আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।'
'প্রতিবারই বড় অগ্নিকাণ্ডের সময় এই সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। বিমা ছাড়া কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না।'
ঢাকা বিমানবন্দর কার্গো কমপ্লেক্সের অগ্নিকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যদি বিমা করা হত, তাহলে সরকার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারত। এখন পুরো আর্থিক ক্ষতি রাষ্ট্র বহন করবে, অর্থাৎ করদাতারা।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বীমা বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন বলেন, এই ব্যর্থতার মূল কারণ 'ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতা'।
'মানুষ মনে করে দুর্যোগ হয় খুব কম, তাই তারা বিমা এড়িয়ে চলে। সরকারও প্রায়ই একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা এমন ঘটনায় নিয়মিত প্রিমিয়াম দিতে চায় না, যা ৫০ বছরে একবারও নাও ঘটতে পারে।'
তিনি বলেন, 'সীমিত রাজস্ব, সচেতনতার অভাব এবং আইনি বাধ্যবাধকতার অভাব—এই তিনটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।'
রাজস্ব কম হওয়ায় সরকার শুধুমাত্র জরুরি ব্যয়কে অগ্রাধিকার দেয় এবং বড় দুর্যোগের ঝুঁকি প্রায়ই উপেক্ষা করে।
মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন বলেন, 'বিমা হারানো সময় বা ব্যবসা ফিরিয়ে দিতে পারে না, তবে আর্থিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করে।'
তিনি আরও বলেন, অনেক উন্নত দেশ এমন স্থাপনাগুলোর জন্যও বীমা বাধ্যতামূলক করে, যেখানে ঝুঁকি কম। 'এটি ঘটনার সংখ্যা নয়, প্রস্তুতির বিষয়।'
'বিমা বাধ্যতামূলক করা হলে সচেতনতা বাড়বে,' বলেন মাইন উদ্দিন। তাছাড়া, একবার বিমা বাধ্যতামূলক করা হলে উন্নত সতর্কতার কারণে ঘটনা কমতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড সব স্থাপনা রক্ষায় সরকারি নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য একটি সতর্ক সংকেত।
সেলিম রায়হান বলেন, বিমাকৃত কেপিআইয়ের নিম্ন হার আর্থিক বিচক্ষণতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি একটি পদ্ধতিগত উদাসীনতারই প্রকাশ।
তিনি বলেন, এ ধরনের উচ্চমূল্যের সম্পদের কোনো বিমা কভারেজ না থাকা কেবল দুর্বল শাসনব্যবস্থাই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় একটি বিপজ্জনক আত্মতুষ্টিকেও প্রতিফলিত করে।
এই অবহেলার বিস্তৃত প্রভাব গভীরভাবে উদ্বেগজনক। তিনি আরও বলেন, 'বিমা ছাড়া যেকোনো ক্ষতির পুরো বোঝা সরাসরি জনসাধারণের পকেটে ওপর পড়ে।'
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'কোটি কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ অরক্ষিত রাখা উচিত নয়।'
তিনি যোগ করেন, 'সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে যথাযথ মূল্যায়ন, মনিটরিং এবং জবাবদিহিতার সঙ্গে সব কেপিআইয়ের জন্য বিমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তা না হলে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড জনসাধারণের অর্থ নষ্ট করবে এবং জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করবে।'
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে দ্বৈপায়ন বরুয়া অবদান রেখেছেন]
Comments