উপদেষ্টা-সচিবরা বিদেশ সফরের নিয়ম ভাঙায় ক্ষুব্ধ প্রধান উপদেষ্টা

দফায় দফায় নির্দেশনা জারির পরও বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করছেন না খোদ উপদেষ্টা ও সচিবরা। বিষয়টিতে সরকার প্রধান ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ জন্যই বিদেশ সফরে নিয়ম মানাকে কেন্দ্র করে পূর্বে জারি করা নিয়ম-কানুন এবার তৃতীয়বারের মতো মনে করিয়ে দিয়ে উপদেষ্টা ও সচিবদের সতর্ক করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
একইসঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিদেশ সফর এড়িয়ে চলার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে উপদেষ্টা ও সচিবসহ দপ্তর-সংস্থার প্রধানদের।
মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব সাইফুল্লাহ পান্নার সই করা এ সংক্রান্ত পরিপত্র মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সব সিনিয়র সচিব, সচিব ও দপ্তর-সংস্থার প্রধানদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, 'নির্দেশনা অনুসরণ না করে বিদেশ ভ্রমণের ঘটনা ঘটছে। মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও সচিব একইসঙ্গে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। একই মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা একসঙ্গে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন।'
'এ ধরণের প্রস্তাব প্রায়ই এ কার্যালয়ে (প্রধান উপদেষ্টা বরাবর) প্রেরণ করা হচ্ছে, যা পূর্বে জারি করা নির্দেশনার পরিপন্থী' বলে মঙ্গলবারের পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত জারিকৃত সব নির্দেশনা প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একান্ত অপরিহার্য কারণ ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ পরিহার করতে হবে।
গত বছর আগস্টে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর বিদেশ সফর সীমিত করতে ১৩ দফা নির্দেশনা দেয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
এতে বলা হয়েছিল, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ ব্যতিরেকে কোনো মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব একসঙ্গে বিদেশ সফরে যাবেন না। একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধীন অধিদপ্তর বা সংস্থা প্রধানরা একান্ত অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থ ছাড়া একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে যাবেন না।
১৩ দফা নির্দেশনার পরও সেটা মানা হচ্ছিল না। তাই চলতি বছরের ২৫ মার্চ সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ সফরের বিষয়ে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বরের অনুশাসন মেনে চলার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
এখন তৃতীয় দফায় গত মঙ্গলবার আবারো নতুন পরিপত্র জারি করলো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিলেও কেন অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরের লাগাম টানা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা নিয়ম মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার? আমার ধারণা কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এ কারণেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।'
তিনি বলেন, 'দু-একজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে এ নির্দেশনা না মানার কারণে সরকার কড়া শাস্তি দিক, তখন দেখবেন পরবর্তী সময়ে কেউ আর নিয়ম লঙ্ঘন করবে না।'
'বারবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করা এক ধরণের দুর্বলতা' বলে মনে করেন ফিরোজ মিয়া।
বিদেশ সফরে মানতে হবে যেসব নির্দেশনা
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ৯ ডিসেম্বর মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়ার সই করা পরিপত্রে ১৩ দফা নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে—
- সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হবে।
- বছরের সম্ভাব্য বিদেশ ভ্রমণের একটা তালিকা জানিয়ে রাখতে হবে।
- বিদেশ ভ্রমণের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার অফিস এর কাঠামো তৈরি করে দেবে এবং এর তথ্য সংরক্ষণ করবে।
- সব স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা একাধারে বিদেশ ভ্রমণ পরিহার করবেন।
- মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও সচিব একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ সাধারণভাবে পরিহার করবেন। তবে জাতীয় স্বার্থে এমন ভ্রমণ অপরিহার্য হলে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
- মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধীন অধিদপ্তর বা সংস্থা প্রধানরা একান্ত অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থ ছাড়া একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে যাবেন না।
- বিদেশে অনুষ্ঠিতব্য সেমিনার বা ওয়ার্কশপ ইত্যাদিতে অংশ নিতে উপদেষ্টা ও সচিবপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং অপরাপর অংশগ্রহণকারী দেশ থেকে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নিচ্ছেন আমন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সেসব তথ্য উল্লেখ করবেন।
- বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাবনায় ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা ও প্রস্তাবিত কর্মকর্তার ওই কার্যক্রমে সংশ্লিষ্টতা ও উপযোগিতার বিষয় উল্লেখ থাকতে হবে।
- কেনাকাটা, প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন কিংবা ফ্যাক্টরি অ্যাকসেপ্ট্যান্স টেস্ট ইত্যাদির ক্ষেত্রে শুধু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পাঠানোর বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
- সরকারি অর্থে কম প্রয়োজনীয় ভ্রমণ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
- সবস্তরের সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে বিনোদন ভ্রমণ পরিহার করবেন।
- সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা ছুটিতে যাওয়া পরিহার করবেন।
- বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত কর্মকর্তার আগের এক বছরের বিদেশ ভ্রমণ বৃত্তান্ত সংযুক্ত করতে হবে।
Comments