যেভাবে নিজেদের ভাগ্য বদলেছেন মথুরাপুর গ্রামের মানুষ
পাবনার চাটমোহর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম মথুরাপুর। কয়েক দশক আগে দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে মথুরাপুরের অনেকেই ছুটে যেতেন দূর-দূরান্তে। দেশের আর পাঁচটি গ্রামের মতোই কৃষিকাজ আর গবাদি পশুপালনই ছিল এ গ্রামের মানুষের জীবিকা ও দৈনন্দিন জীবনচর্চার মূল ভরসা। তবে দুই দশকে বদলে গেছে সেই চিত্র। এখন আয়ের পথ খুঁজতে দেশের প্রায় সব জেলা থেকে মানুষ আসে মথুরাপুরে। কোনো বিশেষ বিনিয়োগ বা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নয়—উন্নত জাতের গাভী সরবরাহের মাধ্যমে গ্রামের মানুষই বদলেছেন নিজেদের ভাগ্য।
মথুরাপুর গ্রামে নেই কোনো বড় গো-খামার, তবু এখানেই পাওয়া যায় উন্নত জাতের দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদি পশু। দুগ্ধ সমৃদ্ধ পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার খামারি এবং কৃষকদের কাছ থেকে উন্নত জাতের গর্ভবতী গাভী সংগ্রহ করে এ গ্রামে আনা হয়। তারপর সেগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরা হয়, যা দেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খামারিরা ছুটে আসেন এই ছোট গ্রামে। দেখে-শুনে দাম ঠিক করে, খামারিরা পশু কিনে নিয়ে যান নিজেদের খামারে।
সরেজমিনে মথুরাপুর গ্রামে দেখা যায়, গ্রামের পাকা রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গরুর খামার। তবে প্রচলিত খামারের মতো এখানে নেই পরিপূর্ণ খামার ঘর। গবাদি পশুর জন্য খামারের মডেলে ঘর তৈরি করা হলেও, সেগুলোতে নেই কোনো বেড়া, যেন বাইরে থেকে গাভীগুলো ভালোভাবে দেখা যায়।
খামারিরা জানান, মথুরাপুরের খামারগুলোতে গবাদিপশু পালন করা হয় না, এখানে বিক্রির জন্য আনা হয়। প্রতিটি খামারে ১০ থেকে ১৫ দিন গরু রাখা হয়। বিক্রি হওয়ার পর আবার নতুন পশু আনা হয়।
তারা আরও জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখানে গর্ভবতী গাভী এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাছুসহ গাভী আনা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুগ্ধ খামার গড়ে ওঠায়, খামারিরা শুনে-দেখে এখান থেকে তাদের পছন্দের গাভী কিনে নিয়ে যান। পছন্দের পশু কিনতে দেশের প্রায় ৬৪ জেলা থেকে খামারিরা ছুটে আসেন এই গ্রামে।
মথুরাপুর গ্রামের গবাদি পশুর ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই অঞ্চল থেকে পশু কিনতে অতীতেও দেশের বিভিন্ন স্থানের খামারিরা আসতেন, গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে তাদের পছন্দের পশু বেছে নিয়ে যেতেন। একসময় আমরা এসব খামারিদের জন্য বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে পশু সংগ্রহ করতাম।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তী সময়ে আমরা নিজেরাই কিছু দুগ্ধ উৎপাদনক্ষম গাভী সংগ্রহ করে ব্যবসায়ী ও খামারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিক্রি করতাম। এতে আমাদেরও কিছু লাভ হতো, আর দূর-দূরান্তের খামারিদের কষ্টও কিছুটা লাঘব হতো। ব্যক্তি পর্যায়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে গ্রামে গড়ে উঠেছে খামারের শেড এবং বাড়তে থাকে গাভীর আমদানি।
রফিকুল বলেন, বর্তমানে এ গ্রামে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি শেড রয়েছে। অন্তত ২০টি খামারের নামে এসব শেডে সারা বছর অন্তত ৩০০ থেকে ৪০০টি উন্নত জাতের গাভী পাওয়া যায়। প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৪০০টি দুধের গাভী দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালের পর ২০ বছরে এ গ্রামে দুধের গাভীর বাজার প্রসারিত হয়ে বর্তমানে জেলার অন্যতম প্রধান পশুর বাজারে পরিণত হয়েছে মথুরাপুর গ্রাম।
মথুরাপুর গ্রামের বাসিন্দা রাশিদুল ইসলাম বলেন, একসময় চায়ের দোকানদারি করে কোনোমতে সংসার চালাতাম। ২০০৫ সালে জমানো টাকার সঙ্গে কিছু ধার নিয়ে ৬০ হাজার টাকায় একটি গাভী কিনে দুদিন পরেই ২০ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করি। পরে চায়ের দোকানের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে একটি-দুটি গাভী নিয়ে এসে বিক্রি করতাম। একসময় চায়ের দোকান ছেড়ে একটি খামারের শেড দিয়েছি।
তিনি বলেন, এখন আমার খামারে ১০ থেকে ১৫টি গাভী থাকে। প্রতি মাসে অন্তত ১২ থেকে ১৫টি গাভী বিক্রি করি। এতে মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকার লাভ হয়। খামারে গাভী আনার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সাধারণত সেগুলো বিক্রি হয়ে যায়।
মথুরাপুর গ্রামের জনি ইসলাম বলেন, প্রায় এক দশক আগে আমি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করি। সেসময় ১০-১৫ হাজার টাকার চাকরির পেছনে না ছুটে আমি একটি খামারের শেড খুলে শুরু করি গাভীর ব্যবসা। গ্রামে ঘুরে সেরা জাতের গাভী সংগ্রহ করে খামারে এনে উন্নত পরিচর্যা এবং ভিডিও আপলোড করি খামারের পেজে। এর পরই ক্রেতারা ভিডিও দেখে যোগাযোগ করেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমার দুটি খামার থেকে প্রতি মাসে অন্তত ১৫ থেকে ২০টি গাভী বিক্রি করি। মাসে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়।
জনি বলেন, আমার খামারে সদ্য প্রসূত গাভীর বাছুর সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, এছাড়া দূর-দূরান্তের খামারিদের থাকার জন্য আবাসিক সুবিধাও রয়েছে। গর্ভবতী গাভী ও সদ্য প্রসূত বাছুরসহ গাভীগুলো আমাদের নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলার খামারিদের কাছে পাঠানো হয়।
সিলেটের মৌলভীবাজারের খামারি নুর মোহাম্মাদ বলেন, একসময় খামারের গাভী কিনতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনের পর দিন ঘুরতে হতো। এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গাভীগুলো দেখে ফোনে যোগাযোগ করা যায় এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে সরাসরি দেখে অনেক সময় খামারে না গিয়েও গাভী কিনতে পারি। মথুরাপুর গ্রামের খামারিরা নিজ দায়িত্বে পশুগুলো আমাদের খামারে পাঠিয়ে দেন। এতে সময়, শ্রম ও খরচ বাঁচে।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. জহুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, পাবনা জেলা গত কয়েক দশকে দেশের অন্যতম শীর্ষ গবাদি পশু উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এ জেলায় প্রায় নয় হাজার ৬৬৫টি রেজিস্টার্ড খামার এবং গবাদি পশুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট লাখ। প্রতি মাসে ২৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। জেলার চাহিদা মিটিয়ে পাবনার গবাদি পশু ও দুধ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, পাবনার চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর গ্রাম এবং ভাঙ্গুরা উপজেলার হারুপারা গ্রামে অনলাইন ভিত্তিক গবাদি পশুর বাজার গড়ে উঠেছে, যা এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান গবাদি পশুর বাজারজাতকরণ কেন্দ্র। গবাদি পশু আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে, মথুরাপুর গ্রাম তার একটি উদাহরণ। উৎপাদনকারী না হয়েও এ গ্রামের মানুষ নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে গবাদি পশুর সমৃদ্ধ বাজার সম্প্রসারিত করেছে, যা অনুকরণীয়।


Comments