হাটুরিয়ার ১৩ জমিদারের গ্রাম এখন শুধুই স্মৃতি

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

পাবনার বেড়া উপজেলার দুর্গম গ্রাম হাটুরিয়া। এখন দুর্গম মনে হলেও শত বছর আগে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতার কারণে যমুনা নদী পারের এ গ্রামটিই ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নাকালিয়া নদীবন্দর-কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নদীপারের এ অঞ্চল। সে সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারতার কারণে ধীরে ধীরে জমিদার ও প্রভাবশালীরা এ অঞ্চলে বসতি শুরু করেন।

প্রথমে এ গ্রামে দুজন জমিদার বসতি শুরু করলেও ধীরে ধীরে অনেক জমিদার আর ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে গড়ে উঠে বড় বড় প্রাসাদ, মন্দিরসহ অনেক স্থাপনা।

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

ঐতিহাসিকদের মতে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির আগে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত একে একে ১৩ জন জমিদার এই ছোট্ট গ্রামটিতে বসতি গড়ে তোলেন। জমিদারির কিছুই অবশিষ্ট না থাকলেও কালের বিবর্তনে গ্রামটি তের জমিদারের গ্রাম হিসেবেই সুপরিচিত।

সময় গড়িয়েছে, অধিকাংশ প্রাচীন জমিদার বাড়ি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এখন প্রাচীন ঐতিহ্যের তেমন কিছুই চোখে না পরলেও জীর্ণশীর্ণ কিছু পুরনো স্থাপনা এখনও হারিয়ে যাওয়া কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সময়মতো উদ্যোগ না নেওয়ায় কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন এসব ঐতিহ্য। 

ঐতিহ্যের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে পলেস্তারা খসা ভগ্নপ্রায় একটি অট্টালিকা, জমিদারদের শানবাঁধানো পুকুর, বাড়ির প্রবেশমুখে বাঘ-সিংহের পাথরের মূর্তি, পুরনো মন্দিরের স্মৃতি চিহ্ন।

ভগ্নদশায় উপনীত হলেও হাটুরিয়া গ্রামের এই জমিদারির গল্প আজও লোকমুখে প্রচলিত। জমিদারদের পাইক-পেয়াদার কথা, গানের আসরের কথা, পাশেই যমুনা নদীতে রাজাদের ভাসমান প্রমোদতরীর কথা মানুষের মুখে মুখে গল্প হয়ে বেঁচে আছে।

এলাকার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই হাটুরিয়া। বড় বড় বণিক বাস করতেন এ অঞ্চলে। পার্শ্ববর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র নাকালিয়া বাজারের সঙ্গে কলকাতার নৌপথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল।

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

স্থানীয়দের তথ্য মতে, এই গ্রামে আবাস গড়া ১৩ জন জমিদার হলেন প্রমথনাথ বাগচী, কাঞ্চীনাথ বাগচী, উপেন্দ্রনাথ বাগচী, ভবানীচরণ বাগচী, কালীসুন্দর রায়, ক্ষীরোদচন্দ্র রায়, সুরেনচন্দ্র রায়, সুধাংশুমোহন রায়, শক্তিনাথ রায়, বঙ্কিম রায়, ক্ষুদিরাম পাল, যদুনাথ ভৌমিক ও যতীন্দ্রনাথ ভৌমিক।

স্থানীয়দের ভাষ্য, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রজাবৎসল ছিলেন প্রমথনাথ বাগচী, আর প্রজাপীড়ক ছিলেন যদুনাথ ভৌমিক। তবে এক গ্রামে এত জমিদার থাকলেও তাদের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতো না। বিভিন্ন পূজা-পার্বণ সবাই মিলেমিশে পালন করতেন।

জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর দেশভাগের আগে-পরে তারা সবাই একে একে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে যান। দু-একজনের বংশধরেরা থেকে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তারাও চলে যান।

জমিদারদের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হতে থাকে তাদের স্থাপনা, সম্পদ আর ঐতিহ্য।

জমিদারদের প্রত্যেকেই বাস করতেন প্রাচীরঘেরা অট্টালিকায়। অট্টালিকার পাশেই ছিল শানবাঁধানো ঘাট। সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে বর্তমানে বেশির ভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। যে কয়েকটি অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও করুণ।

একই রকম অবস্থা বড় বড় অট্টালিকার। মালিকানা বদলের পর কিছু ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিছু যত্নের অভাবে ভেঙে গেছে। সাক্ষী হিসেবে গ্রামে এখনো দু-তিনটি অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ রয়ে গেছে। জরাজীর্ণ এসব অট্টালিকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে কয়েকটি পরিবার।

এমনি এক দ্বিতল অট্টালিকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন দিলীপ গোস্বামী। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ইজারা নিয়ে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় বাস করছেন পরিবারটি।

দিলীপ গোস্বামীর ছেলে পলাশ গোস্বামী জানান, অট্টালিকার একস্থানে এর নির্মাণকাল ১৯১১ সাল এবং নির্মাতা হিসেবে জমিদার ক্ষীরোদচন্দ্র রায়ের বাবা উমেশচন্দ্র রায়ের নাম খোদাই করা ছিল।

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

তিনি ছেলেবেলায় এখানে সুপরিসর জলসাঘরসহ অনেক কক্ষ দেখেছেন। হলরুমে ক্ষীরোদচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষের ছবি ছিল। জলসাঘরসহ সবকক্ষই এখন জরাজীর্ণ। ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে।

কয়েক বছর আগে ভবনটির বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ফাটল ধরেছে, ভাঙ্গাচোরা ভবনটিতে গাছ জন্মেছে। ফলে বসবাসের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পরেছে সেটি। মূল ভবনের পেছনে আলাদা ঘর তুলে বসবাস করছে পরিবারটি।

ভবনের কিছু দূরেই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এক মন্দির। স্থানীয়রা একে শ্যামা রায়ের ঘর হিসেবেই চেনেন।

পলাশ গোস্বামী জানান, তাদের পূর্বপুরুষেরা এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন, এখানে স্বর্ণের মূর্তি ছিল বলে তারা শুনেছেন।

গ্রামের আরেক প্রান্তে রয়েছে শান বাঁধান বিশাল পুকুর। স্থানীয়রা জানান. এর নাম বিমলা পুকুর।

গ্রামের বাসিন্দা শাজাহান আলী বলেন, 'রায় পরিবারের জমিদাররা এই পুকুরটি বানিয়েছিলেন। পুকুরের পাশের জমিদারদের ভগ্ন দশায় পরে থাকা ভবনটি আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। কিন্তু, কেউ সেই ভূতুরে মহলে ঢোকার সাহস করত না। কালের বিবর্তনে জমিদার বাড়ির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এখানে গড়ে উঠেছে স্থানীদের আবাসস্থল। পরে আছে সেই শান বাঁধান পুকুর।'

শাজাহান বলেন, 'এক সময় নদী থেকে সরাসরি খালের মাধ্যমে এই পুকুরে পানি আনা হতো। কালের বিবর্তনে নদী অনেক দূরে চলে গেছে, হারিয়ে গেছে সেই খাল। কয়েক দশক আগে পুকুরটিও শেষ হয়ে যায়।'

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে পুকুরটি সংস্কার করে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এখন গ্রামের মানুষের ব্যবহার্য পানির বড় অংশই মেটে এই বিমলা পুকুর থেকে।

গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, আরও একটি শান বাঁধান পুকুর সেখানে আছে। স্থানীয়রা জানান, অতীতে এখানেই একটি জমিদার বাড়ি ছিল। এখন অস্তিত্ব নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে বাড়ি-ঘর।

কথা হয় আশি-ঊর্ধ্ব আরদাশ ফকিরের সঙ্গে। তার বংশধরেরাই এখন বসবাস করছে সেই জায়গায়। তিনি দাবি করেন, এসব সম্পত্তি অনেক আগেই কিনে নিয়েছেন। পুরনো স্থাপনা ভেঙে গড়ে তুলেছেন বসতি। সব কাগজ আছে তার কাছে।

এভাবেই পুরো গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্থাপনাগুলো ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে স্থানীয়দের আবাসস্থল।

গ্রামবাসীরা জানান, পুরনো জমিদারদের স্মৃতি ঘেরা এই গ্রামের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য কখনই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে কালের বিবর্তনে বেশিরভাগই ধ্বংস হয়েছে।

হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ বলেন, 'ভাবতে অবাক লাগে, ১৩ জন জমিদারের বসবাস করা ঐতিহ্যবাহী জমজমাট গ্রামটির আজ কী করুণ দশা। প্রাচীন এসব ঐতিহ্য ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে কালের বিবর্তনে জমিদারদের সম্পদ নিজেদের করে নিয়েছে স্থানীয়রা।'

তিনি বলেন, 'প্রথম থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হলে দুর্গম এ গ্রামেই গড়ে উঠতে পারত একটি পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু সময়মতো সরকারিভাবে বা স্থানীয়দের মধ্যে থেকে উদ্যোগ না নেওয়ায় উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার ইতিহাস এই অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে বিলীন হয়েছে।'

বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, 'গ্রামের পুরনো স্থাপনাগুলো প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হলে সংরক্ষণ করা যেত। অতীতে সেভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে এখনও যেসব স্থাপনা রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য কাজ করা হচ্ছে।'

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাচারিবাড়ির কাস্টডিয়ান শাউলি তালুকদার বলেন, 'প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য বিবেচনা করেই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ঘোষণা করা হয়। সাইট পরিদর্শন করার আগে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারব না।'

Comments