অতিরিক্ত ব্যয় ও সুরক্ষার ঘাটতিতে ভঙ্গুর বাংলাদেশের শ্রম রপ্তানি
রেকর্ডসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে গেলেও বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের বাস্তব চিত্র খুব একটা বদলায়নি। একক বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, আকাশছোঁয়া অভিবাসন ব্যয়, দুর্বল সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং অদক্ষ শ্রম রপ্তানির পুরোনো চক্র—সব মিলিয়ে দেশের শ্রম রপ্তানি ব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুরই রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করতে গেলেও এই প্রবণতার ভেতরে লুকিয়ে আছে বড় ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত ১০ লাখ ৭১ হাজার ৫৭০ জন বাংলাদেশি কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ৭ লাখ ১২ হাজার ৪৪ জন, যা মোট সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের ওপর এত বেশি নির্ভরতার ফলে সৌদি আরবের নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এলেই বাংলাদেশ বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ জন বাংলাদেশি নারী বিদেশে কাজ করতে যান, যা ২০২০ সালের মহামারি-পরবর্তী মন্দা কাটিয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিয়েছিল। তবে মহামারীর আগে যেখানে প্রতিবছর নারী অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখ ছাড়াত, সেখানে পরবর্তী সময়ে তা ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
২০২৪ সালে নারী অভিবাসীর সংখ্যা নেমে আসে ৬০ হাজারের কিছু বেশি। সর্বশেষ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট প্ল্যাটফর্মের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে গেছেন ৫৬ হাজার ২৯২ জন নারী, যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ৪৭ শতাংশ কম।
এই প্রবণতা বদলাতে বা নিরাপদ ও দক্ষ নারী কর্মী পাঠাতে এখনো কোনো সুস্পষ্ট কৌশল দেখা যাচ্ছে না।
প্রবাসী কল্যাণ খাতে বাজেট বরাদ্দও কমেছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫৫ কোটি টাকায়। গত পাঁচ বছরে জাতীয় বাজেটের গড়ে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এই খাতে
অথচ প্রবাসীরা প্রতিবছর ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, 'এই বরাদ্দ কমে যাওয়াই স্পষ্ট করে দেয় যে প্রবাসী কল্যাণকে অগ্রাধিকার হিসেবে দেখা হয়নি।'
তার মতে, প্রবাসী লাউঞ্জ, বিদেশে পোস্টাল ব্যালটে ভোটাধিকার কিংবা সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শ্রমচুক্তির মতো সাম্প্রতিক সরকারি উদ্যোগগুলো কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
তিনি বলেন, 'ভোটের উদ্যোগ প্রতীকীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই খাতের দরকার ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তার বদলে মন্ত্রণালয় দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজে সীমাবদ্ধ থেকেছে এবং অভিবাসন ব্যবস্থাপনা নতুন করে সাজানোর ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করেছে।'
আগের সরকার পতনের পর বিশেষজ্ঞরা দক্ষতা উন্নয়ন, কল্যাণ, নিয়োগ সংস্কার ও শ্রম কূটনীতি নিয়ে একটি 'ন্যাশনাল মাইগ্রেশন ডিকেড' ঘোষণার কথা বললেও বাস্তবে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
শ্রমিকের কাঁধে সবচেয়ে বড় বোঝা—অভিবাসন ব্যয়
বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য এখনো অভিবাসনের সবচেয়ে বড় সমস্যা অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, অনিয়ন্ত্রিত দালালদের কারণে একই বাজারে যেতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নেপালি শ্রমিকদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়।
তিনি বলেন, 'বিমানবন্দরে হয়রানি কমানো জরুরি। শুধু লাউঞ্জ করলেই সমস্যা মেটে না। শ্রমিকেরা চান ঝামেলাহীন অভিজ্ঞতা, বাহ্যিক সাজসজ্জা নয়।'
অধ্যাপক তাসনিম বলেন, 'সরকার ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অতিরিক্ত টাকা নেওয়া সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।'
তিনি বলেন, 'যে ব্যবস্থায় শ্রমিককে সুরক্ষা দেওয়ার কথা, সেই ব্যবস্থার খরচই শ্রমিককে বহন করতে হচ্ছে।'
প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৩ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে গঠিত ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ডের বড় অংশ প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হচ্ছে, বিপদে পড়া শ্রমিকদের সহায়তায় নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এখনো কম দক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করছে স্বল্প মজুরির বাজারে। বিএমইটির প্রশিক্ষণগুলো স্বল্পমেয়াদি, দুর্বলভাবে স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে দক্ষ শ্রম অভিবাসনের একটি ধারাবাহিক পথ তৈরি হয়নি।
অধ্যাপক তাসনিম বলেন, 'এই সমন্বয়হীনতাই বাংলাদেশকে নিম্নমূল্যের শ্রম রপ্তানির ফাঁদে আটকে রেখেছে।'
তিনি আরও জানান, নার্সিং ও কারিগরি পেশায় বড় সুযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নার্সিং ডিগ্রি দিতে না পারায় সেই সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
যদিও সাব-এজেন্ট নিবন্ধনের আইনি সুযোগ রয়েছে, অধ্যাপক তাসনিমের মতে, বিধিমালাগুলো এমনভাবে করা হয়েছে যেন জবাবদিহি দুর্বল হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় ডিজিটাল নিবন্ধন ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রস্তাব উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে নিয়োগকারীরা দায় এড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন, আর শ্রমিকরা ন্যায়বিচারের পথ পাচ্ছেন না।'
এদিকে মালয়েশিয়া, উপসাগরীয় দেশগুলো ও ইউরোপ থেকে আসা প্রতিবেদনে দূতাবাস সেবার দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতার চিত্র উঠে এসেছে। শ্রম উইংগুলো প্রায়ই জনবলস্বল্প, ভুলভাবে বণ্টিত এবং শ্রমিকদের জন্য দুর্লভ।
কুয়ালালামপুরে সাত বছর ধরে বসবাসরত এক বাংলাদেশি নির্মাণশ্রমিক বলেন, 'আমরা দূতাবাসে গেলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে বলে বা পরে আসতে বলে। ফোন ধরেই না। মালিকের সঙ্গে সমস্যা হলে কোনো দিকনির্দেশনা পাই না।'
তিনি আরও জানান, দূতাবাস-সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা অনেক সময় 'সমস্যা সমাধানের বদলে বাধা তৈরি করেন'। ফলে জরুরি অবস্থাতেও শ্রমিকদের বেসরকারি দালালের কাছে যেতে হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার এখনো মালয়েশিয়া, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার খুলতে পারেনি। আগের বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়টি বাজারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারেনি।
শরিফুল হাসান সতর্ক করে বলেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী বছর বিদেশে কর্মী পাঠানো হঠাৎ কমে যেতে পারে।
এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গন্তব্য সৌদি আরবেও এখন নতুন কড়াকড়ি আসছে—তাকামুল সনদ, ইকামা প্রক্রিয়ায় দেরি, বেতন পরিশোধে বিলম্ব ও চাকরি বদলের জটিলতা শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে।
শরিফুল বলেন, 'এই চাপগুলো একটি বড় ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করছে। পুরো ব্যবস্থা একটি বাজারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সৌদি আরবে সামান্য নীতিগত পরিবর্তনই পুরো ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে।'
আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস ২০২৫। তবে অনেক শ্রমিকের কাছে এসব দিবসের উদযাপন ফাঁপা মনে হয়।
মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রবাসী শ্রমিক নিলয় মজুমদার বলেন, 'আমরাই দেশে ডলার পাঠাই। কিন্তু বিপদে পড়লে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।'
অধ্যাপক তাসনিম বলেন, 'বাংলাদেশ এখনো রেমিট্যান্সকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু যারা সেই রেমিট্যান্স এনে দেন, সেই শ্রমিকদের অগ্রাধিকার নেই।'
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।


Comments