চর হাট: ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলের অসম অর্থনীতি

ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে দুর্গম চর দৈখাওয়া। মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে এই চরে মানুষের জীবন নানা অনিশ্চয়তায় ভরা।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের এই চরে বসবাস করেন প্রায় ৭০টি কৃষক পরিবার। বালুময় জমিতে তারা ধান, ভুট্টা, পাট, কাউন, গম, চিনা ও ডালসহ নানা ফসল ফলান। কিন্তু ফসল উৎপাদনের চেয়েও বড় সংগ্রাম শুরু হয় বিক্রির সময়।

ছবি: এস দিলীপ রায়

৬৫ বছর বয়সী কৃষক জাবেদ আলী জানান, নদীতে পলি জমার ওপর নির্ভর করে প্রতিবছর আবাদি জমির পরিমাণ কম-বেশি হয়। বৃষ্টি ও প্রখর রোদে পুড়ে কঠোর পরিশ্রমে ফসল উৎপাদন করলেও ন্যায্য মূল্য পাওয়া তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ছবি: এস দিলীপ রায়

তিনি বলেন, ফসল ফলাতে যে কষ্ট করি, বিক্রি করতে গিয়ে তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয়। নৌকায় করে চর থেকে নদীর পাড়ে অস্থায়ী হাটে যেতে হয়। সেখানে ফসল কম দামে বিক্রি করতে হয়। আবার সার, বীজ, ডিজেলসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয় বেশি দামে। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় মূল ভূখণ্ডের হাটে যেতে পারি না।

ছবি: এস দিলীপ রায়

জাবেদ আলীর মতে, মূল ভূখণ্ডের বাজার দরের তুলনায় তারা ফসল বিক্রি করেন ৮–১০ শতাংশ কম দামে এবং প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হয় ৮–১০ শতাংশ বেশি দামে।

একই চরের আরেক কৃষক আজগর আলী মন্ডল (৭৫) জানান, যুগের পর যুগ ধরে চরের হাটগুলো এভাবেই চলছে। নদীর গতিপথ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে হাটের অবস্থানও পরিবর্তিত হয়।

তিনি বলেন, চরের হাট অস্থায়ী। নদীর কিনারা যেদিকে থাকে, সেদিকেই হাট বসে। মূল ভূখণ্ডের ব্যবসায়ীরাই এখানে পণ্য আনেন এবং আমাদের কাছ থেকে কিনেন। কম দামে বিক্রি আর বেশি দামে কেনা—এটাই আমাদের নিয়তি।

ছবি: এস দিলীপ রায়

কুড়িগ্রাম চর উন্নয়ন কমিটির তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও দুধকুমার নদীর বুকে ৬৫০টির বেশি চর রয়েছে। শুধু কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের বুকে রয়েছে প্রায় ৪৫০টি চর। এই চরের মানুষের জন্য আছে মাত্র ১৮–২০টি চর হাট।

চিলমারীর দুর্গম চর কড়াই বরিশালের কৃষক নাসির উদ্দিন (৬০) বলেন, চরের হাট আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও কষ্টের জায়গা। কম দামে ফসল বিক্রি করি, আবার বেশি দামে পণ্য কিনি। মূল ভূখণ্ডে বিক্রি করা সম্ভব, কিন্তু বালু চরে হেঁটে ফসল নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

তিনি আরও জানান, চর হাটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি স্বর্ণকারও আসেন।

ছবি: এস দিলীপ রায়

চিলমারীর জোড়গাছ চর হাটে আসা চর মনতলার কৃষক নাদিম মন্ডল (৫৫) বলেন, মূল ভূখণ্ডের হাট সাধারণত দুপুরের পর বসে, কিন্তু চরের হাট শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ভোরে প্রস্তুতি নিয়ে হাটে আসি। সকালে পণ্য বিক্রি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নৌকায় ফিরে যাই।

প্রতিটি চর হাটে গড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জন কৃষক ও ১৫০ থেকে ২০০ জন ব্যবসায়ী অংশ নেন। প্রতি হাটে এক কোটি টাকারও বেশি পণ্যের লেনদেন হয়।

ছবি: এস দিলীপ রায়

জোড়গাছ চর হাটের ব্যবসায়ী শামসুল আলম বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে ফসল মূল ভূখণ্ডের বাজার দরের তুলনায় ৮–১০ শতাংশ কম দামে কেনা হয় এবং চরবাসীদের কাছে পণ্য বিক্রি করা হয় ৮–১০ শতাংশ বেশি দামে।

তিনি দাবি করেন, এটা বৈষম্য নয়। পুরো পার্থক্যই পরিবহন খরচে। দুর্গম চরে পণ্য পরিবহনের একমাত্র বাহন ঘোড়ার গাড়ি। প্রতি মণ পণ্য পরিবহনে খরচ পড়ে ১২০–১৫০ টাকা।

কৃষিপণ্য বিক্রেতা সাহেদ আলী বলেন, সার, বীজ, কীটনাশক ও ডিজেল মূল ভূখণ্ড থেকে ঘোড়ার গাড়িতে আনতে হয় এবং অবিক্রিত পণ্যও ফেরত নিতে হয় একইভাবে। পরিবহন খরচের কারণে বাড়তি দাম দিতে হয় বলে জানান তিনি।

ঘোড়ার গাড়িচালক মজিদুল ইসলাম জানান, তিনি প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা আয় করেন, যার অর্ধেকই খরচ হয় ঘোড়ার খাদ্যে।

গত ২০ বছর ধরে তিনি এই পেশায় রয়েছেন। প্রতিটি চর হাটে ৫০ থেকে ৬০টি ঘোড়ার গাড়ি থাকে এবং প্রতিটি গাড়িতে ১০ থেকে ১২ মণ পণ্য পরিবহন করা যায়। বালু চরে প্রতি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট।

কুড়িগ্রাম চর উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন, চরের মানুষ কম দামে পণ্য বিক্রি ও বেশি দামে পণ্য ক্রয়সহ নানা বৈষম্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রকল্প নেওয়া হলেও চরের মানুষের মৌলিক সমস্যা সমাধান হয়নি। পৃথক 'চর মন্ত্রণালয়' গঠন ছাড়া চরের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

অধ্যাপক বেবু মনে করেন, চর মন্ত্রণালয় গঠিত হলে চরের সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে পরিকল্পিতভাবে হাট, যোগাযোগ ও বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যেখানে চাষিরা ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি ও ক্রয় করতে পারবেন।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s janaza held

The namaz-e-janaza of BNP Chairperson Khaleda Zia was held at the South Plaza of the Jatiya Sangsad Bhaban today

6h ago