হেফাজতের বিবৃতি ও দ্য ডেইলি স্টারের জবাব

দ্য ডেইলি স্টার গভীর দুঃখ ও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছে—হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী এক বিবৃতিতে আমাদের বিরুদ্ধে 'ইসলামবিদ্বেষী ফ্রেমিং'-এর ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন।
তিনি বিগত সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান নিয়ে আমাদের প্রতিবেদনগুলো সম্পর্কে যেসব অভিযোগ করেছেন—তা সম্পূর্ণ অসত্য। দ্য ডেইলি স্টার শুধু সংশ্লিষ্ট সংস্থার দেওয়া তথ্য ও বক্তব্য অনুযায়ী সংবাদ প্রকাশ করেছে, কোনো নতুন তথ্য যোগ করেনি বা তথ্য বিকৃতি করেনি। একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং থেকে নেওয়া তথ্য দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমও প্রকাশ করেছে। দ্য ডেইলি স্টার তা থেকে ভিন্ন নয়—যে পেশাগত মানদণ্ড আমরা এখনো অনুসরণ করে যাচ্ছি।
এই ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো প্রকৃতপক্ষে বিগত কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে সত্য বলার সাহসিকতার নজির স্থাপন করা স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানোর অপচেষ্টা। সত্য প্রকাশের কারণে দ্য ডেইলি স্টারকে গণভবন ও সরকার প্রধানের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অন্যদিকে, শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ওপরও বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে ডেইলি স্টারের রাজস্ব প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়। একইসঙ্গে পত্রিকার সম্পাদক দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দায়ের করা ৮৪টি মামলার মুখোমুখি হন—যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এমনকি সংসদে প্রধানমন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও প্রকাশ্যে তাকে নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন। তবুও দ্য ডেইলি স্টার কখনো মাথা নত করেনি এবং সত্য বলা ও সরকারের সমালোচনা করা বন্ধ করেনি।
দ্য ডেইলি স্টার ও এর সম্পাদক কখনো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন 'ওয়ার অন টেরর' এর বয়ানকে সমর্থন করেনি, বরং 'ইসলামফোবিয়া' ও পশ্চিমা গণমাধ্যমের দ্বিচারিতা উন্মোচন করেছে। দ্য ডেইলি স্টার ফিলিস্তিনের ন্যায্যতার পক্ষে সর্বদা সোচ্চার ছিল। সংবাদ প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও মতামত বিভাগে সম্পাদকের কলামসহ বিভিন্নভাবে এই পত্রিকা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও 'গণহত্যা'র বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর 'স্টপ দ্য জেনোসাইড' শিরোনামে গাজার গণহত্যা নিয়ে একটি বিশেষ পাতা প্রকাশ করে ডেইলি স্টার—যা আমাদের আপসহীন সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন।
বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, ডেইলি স্টার যাচাই না করেই 'র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহকৃত জঙ্গিবিষয়ক খবর' প্রকাশ করেছে—যা ভিত্তিহীন। এক্ষেত্রে আমরা অন্যান্য গণমাধ্যমের মতোই বিদ্যমান নিয়মে খবর প্রকাশ করেছি। র্যাবের কার্যক্রম ও গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার বরাবরই সমালোচনা করে এসেছে এবং এসব বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করেছে।
হেফাজতে ইসলামের মতো একটি সংগঠনের দায়িত্বশীল ব্যক্তি যেভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়া একপাক্ষিক এবং অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মিথ্যা কনটেন্টকে সত্য বলে ধরে নিচ্ছেন—এতে আমরা খুবই হতবাক।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের আমলে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিরোধী মতের অধিকারের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠস্বর ছিল দ্য ডেইলি স্টার। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতিটি পদক্ষেপের সমালোচনা করেছি আমরা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতায় আমাদের ভূমিকা ছিল সাহসী ও অনন্য, যা অন্যদেরও প্রতিবাদে শামিল হতে অনুপ্রাণিত করেছে।
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে—তথ্যভিত্তিক যেকোনো মতামত আমরা সম্মান করি, এমনকি তা আমাদের সমালোচনা হলেও। আমরা সবসময় শিখতে চাই এবং পাঠকদের আরও ভালোভাবে সেবা দিতে চাই।
আমরা হেফাজতে ইসলাম ও বিশেষ করে তাদের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি—স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার আগে অনুগ্রহ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য সতর্কভাবে যাচাই করুন।
কারণ, আমরা বিগত শাসনামল থেকে একটি শিক্ষা পেয়েছি—স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ছাড়া সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর স্বাধীন গণমাধ্যমকে হেয় করলে, তাতে ক্ষতি হয় গোটা জাতিরই।
Comments