বদরুদ্দীন উমর: এক আলোকিত জীবন

বদরুদ্দীন উমর আর আমাদের মাঝে নেই। ৯৪ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে গেছেন তবে রেখে গেছেন এক দীর্ঘ ও অসাধারণ জীবন। তিনি একাধারে ছিলেন লেখক, গবেষক, শিক্ষক, বামপন্থী রাজনীতিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তক। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়—তিনি ছিলেন সত্য বলার সাহসী মানুষ। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী জগতে তিনি সবসময় ছিলেন এক ভিন্ন কণ্ঠস্বর।
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় বদরুদ্দীন উমরের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান যেখানে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি (পিপিই) বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এটি ছিল অনেক বড় অর্জন, কিন্তু তিনি কেবল একাডেমিক জীবনেই থেমে থাকেননি। ১৯৬৮ সালে গভর্নর মোনায়েম খানের কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি এবং পরে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে লেখালেখিতে নিবেদিত করেন।
বদরুদ্দীন উমর কখনো আপস করেননি। তিনি প্রকাশ্যে ভণ্ডামি, অজ্ঞতা ও সুযোগসন্ধানির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। হয়তো সেই কারণেই তিনি প্রায়ই বলতেন, বাংলাদেশে তাকে অবহেলা করা হয়েছে। বিশাল কর্মভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও তার বই ও গবেষণা দেশে খুব কম আলোচিত হয়েছে। অথচ কলকাতায় তার লেখালেখি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। কাজী আবদুল ওদুদ, আনন্দশঙ্কর রায়, সমর সেন, অশোক মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা তার বিষয়ে লিখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি থেকে গেছেন প্রায় অবহেলিত।
১৯৭৪ সাল থেকে তিনি সংস্কৃতি পত্রিকা প্রকাশ করে এসেছেন। এর মাধ্যমে এবং তার অসংখ্য বইয়ে তিনি লিখেছেন ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র, বাঙালি মুসলমানের পরিচয়, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংকট নিয়ে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতার প্রকৃত ভিত্তি ১৯৪৭ সালের বিভাজনের সঙ্গে শেষ হয়, পরবর্তীতে মূলত জাতীয়তাবাদকে ঘিরেই সংগ্রাম চলেছে। তার চিন্তাধারা সবসময় লোকপ্রিয় হয়নি, কিন্তু ছিল মৌলিক এবং চিন্তাজাগানিয়া।
তারুণ্যে বদরুদ্দীন উমর সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন—গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে জীবনের শেষ দিকে তিনি অনেকটাই শান্ত জীবনযাপন করেছেন, বিশাল লাইব্রেরির বইয়ের সঙ্গেই কাটত তার সময়। পড়া আর লেখা ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করতেন যে, বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন অনুপস্থিত। বলতেন, এখানে সত্য কথা অবাধে বলা যায় না। তবু তিনি কখনো থেমে থাকেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নির্ভীকভাবে লিখেছেন।
আজ তিনি না থাকায় বোঝা যায়, বদরুদ্দীন উমর কেবল লেখক বা রাজনীতিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার সময়ের দর্পণ। তিনি আমাদের শক্তি, দুর্বলতা ও বৈপরীত্যকে প্রতিফলিত করেছেন।
বদরুদ্দীন উমরকে সম্মান জানানোর সেরা উপায় হলো তাকে পড়া, তার লেখনী ও চিন্তা থেকে শিক্ষা নেওয়া। জীবদ্দশায় হয়তো তিনি অবহেলিত বোধ করেছেন, কিন্তু ইতিহাস তাকে ভুলবে না। তার নির্ভীক কণ্ঠস্বর এবং ন্যায়-সমতার স্বপ্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
নিঃসন্দেহে বদরুদ্দীন উমর ছিলেন চিরন্তন আলোর প্রদীপ।
Comments