বেগম খালেদা জিয়া: এক রাষ্ট্রনায়কের বিদায়

বেগম খালেদা জিয়া। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার ফাইল ছবি

বাংলাদেশ বহু শাসক দেখেছে, কিন্তু খুব কম নেতাই ছিলেন যারা রাষ্ট্রের সঙ্গে এত গভীরভাবে একাকার হয়ে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন তাদের একজন। তার জীবন ও নেতৃত্ব আরাম-আয়েশ বা ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে নয়, গড়ে উঠেছে সংঘাত, সহনশীলতা, পরিপক্বতা ও পরিণতির ভেতর দিয়ে।

খালেদা জিয়ার জীবনের গল্প পড়া মানে বাংলাদেশেরই গল্প পড়া। একটি দেশ, যা আজও ক্ষমতা ও গণতন্ত্র, কর্তৃত্ব ও বিরোধিতা, নেতৃত্ব ও মানবিকতার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে ফেরে।

বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ ও প্রভাবশালী অধ্যায়ের অবসান হলো আজ। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আজ ভোর ৬টায় ইন্তেকাল করেছেন।

১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণকারী খালেদা জিয়া স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ব্যক্তিগত শোক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা তাকে রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসে।

তার রাজনীতিতে আগমন কোনো পরিকল্পিত প্রস্তুতির ফল ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর দল ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধই তাকে এই পথে নিয়ে আসে। সেটাও এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশ নিজেই ভিন্নমত ও গণতন্ত্র পরিচালনার ভাষা শিখছিল।

পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নারী নেতৃত্ব যখন ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হতো, তখন খালেদা জিয়া কেবল লোক দেখানো প্রতীক হয়ে থাকেননি। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, শাসন করেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সময়ের ভার বহন করেছেন।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ছিল বিকাশমান এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তীব্র ও দৃশ্যমান। সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচনভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটি কার্যকর কাঠামো তার সময়েই দৃশ্যমান হয়।

গণশিক্ষা বিস্তারে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ছিল তার সবচেয়ে টেকসই ও স্মরণযোগ্য অবদানগুলোর একটি। তার শাসনামলে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। মেয়েদের শিক্ষা প্রসার ও ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচি সমাজে একটি মৌলিক ধারণাকে স্বাভাবিক করে তোলে যে, কন্যাসন্তানও পুত্রের মতোই শ্রেণিকক্ষে থাকার অধিকার রাখে।

লাখো পরিবারের কাছে এটি কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ছিল না; এটি ছিল জীবনের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়ার সুযোগ। তার নেতৃত্বে নারীদের শিক্ষা দান হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য প্রয়োজন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আজও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও সামাজিক জীবনে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে তার সরকারের উদ্যোগ জনস্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ আচরণগত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান কর্মসূচি এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবার বিস্তারের ফলে জনসচেতনতা ও সেবাগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, যা সামাজিক সূচক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক মানব উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে তার সরকার সময়ের অনেক আগেই উদ্যোগী ভূমিকা নেয়। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় তখন ছিল বিরল ও অগ্রগামী উদ্যোগ। পরিবেশ সচেতনতা যেখানে এখনও মূলধারায় আসেনি, তখন এই নীতিগত সিদ্ধান্ত উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তার স্পষ্ট বার্তা দেয়।

অর্থনৈতিক শাসনে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী অবদানগুলোর একটি ছিল মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তন ও বিস্তার। তার সরকারের সময়েই ভ্যাট আধুনিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এটি রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় ও বাস্তবায়নে জটিল হলেও রাষ্ট্রের রাজস্ব আহরণকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বচ্ছ কাঠামোয় নিয়ে আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা ও উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থায়নে ভ্যাট একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভে পরিণত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা সুদৃঢ় করে।

একই সময়ে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ ও রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির সম্প্রসারণে তার সরকারের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে পোশাক খাতের অবস্থান সুদৃঢ় হয় এবং এই খাত ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তিতে পরিণত হয়।

এই শিল্পে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং আনুষ্ঠানিক ও আধা-আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে নতুন বাস্তবতা তৈরি করে।

দারিদ্র্য বিমোচন ও এনজিওভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রমের বিস্তারে তার সরকারের অবদানও উল্লেখযোগ্য। নব্বইয়ের দশকে দারিদ্র্যকে কেবল পরিসংখ্যান হিসেবে নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা হিসেবে বিবেচনা করার যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, তার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এই সময়েই শক্ত হয়।

ক্ষুদ্রঋণ, আয়বর্ধক জীবিকাভিত্তিক উদ্যোগ, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে রাষ্ট্র ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার সুযোগ তার সময়ই সৃষ্টি হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও জীবিকাভিত্তিক সহায়তায় এনজিওগুলোর মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হয়। এই সম্মিলিত প্রয়াস দারিদ্র্য বিমোচনের আলোচনাকে প্রকল্পনির্ভরতা থেকে মানুষের সক্ষমতা, ক্ষমতায়ন ও আত্মনির্ভরতার দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক হয়।

সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামাজিক ও কমিউনিটি সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া। শিক্ষা কার্যক্রম, স্বাস্থ্য সচেতনতা উদ্যোগ, নারী সংগঠন, কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।

এসব উদ্যোগ সামাজিক সংহতি জোরদার করে, যৌথ উদ্যোগকে উৎসাহিত করে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে কমিউনিটির মালিকানাবোধ গড়ে তোলে। এর সম্মিলিত প্রভাব হিসেবে একটি আরও সক্রিয় নাগরিক সমাজ তৈরি হয় এবং অধিকার, দায়িত্ব ও সম্মিলিত অগ্রগতি সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধীরে ধীরে একটি গভীর রূপান্তর ঘটে।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাকে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি চলে যাবেন। কিন্তু তিনি যাননি। তিনি দেশেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তার কাছে দেশ কোনো আরাম বা সুবিধার জায়গা ছিল না। এটি ছিল তার ঘর। দেশের মানুষ ছিল তার আপন মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, এখান থেকেই তার সবকিছু শুরু এবং এখানেই শেষ।

নীতিনির্ধারণ ও ক্ষমতার বাইরেও তার জীবনের শেষ অধ্যায় বহন করে গভীর বার্তা। দীর্ঘ অসুস্থতা ও নিঃসঙ্গতায় কাটানো সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জীবন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কঠোর বাস্তবতাকে সামনে আনে।

তিনি দশকের পর দশক সংঘাতের ভেতর দাঁড়িয়ে থেকেছেন। নিজের কাঁধে একসঙ্গে বহন করেছেন প্রশংসা ও নিন্দা, আনুগত্য ও অভিযোগ।

ইতিহাস তার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবে। ইতিহাস কখনোই সর্বসম্মত হয় না। কিন্তু, কখনোই অস্বীকার করা যাবে না আধুনিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক নির্মাণে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা, নারী নেতৃত্বে তার অবদান এবং শিক্ষা, শাসন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তার স্থায়ী ছাপ।

দেশ যখন তাকে স্মরণ করবে, তখন কেবল একজন প্রধানমন্ত্রী বা দলনেত্রীকেই স্মরণ করবে না। স্মরণ করবে এমন একজন নারীকে, যিনি এই দেশে ক্ষমতার ভার বহন করেছেন, যেখানে ক্ষমতা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয় এবং যার জীবন রাষ্ট্রের ইতিহাস থেকে আলাদা করে দেখা যায় না।

বিদায়, সহনশীলতার প্রতীক।


তানজিম ফেরদৌস একজন উন্নয়নকর্মী, যিনি দ্য ডেইলি স্টারে কাজ করেন।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia contribution to Bangladesh democracy

A leader who strengthened our struggle for democracy

Khaleda Zia leaves behind an enduring legacy of service.

13h ago