বড় অসময়ে চলে গেলেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। ছবি: ফিরোজ আহমেদ

আমার জীবনের একটা অংশ দাবা। দাবা আমার প্রেম, ভালোবাসা। ভালো খেলতে পারি না। কিন্তু দাবা উৎসাহী। ভালো খেলা নিয়মিত উপভোগ করি। গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রে দাবা সম্পর্কে সামান্য প্রফেশনাল ধারণা আছে। দাবার ওপেনিং, মিডল গেম, এন্ড গেম, বড় দাবা খেলোয়াড়দের বৈশিষ্ট্য এসবই জেনেছি জিয়ার কাছ থেকে। ওর কাছ থেকে অনেক ওপেনিং সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। জিয়া অনেক বই আমাকে পড়তে দিয়েছে। দাবা বিষয়ক বই।

গত ৫ জুলাই চলে গেলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান দাবা খেলোয়াড় জিয়াউর রহমান। তিনি ১৭ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। দেশে বিদেশে বহু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভালো ফলাফল করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় দাবা দলে প্রথম বোর্ডে প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন।

বাংলাদেশে আরও গ্র্যান্ডমাস্টার আছেন। নিয়াজ মোর্শেদের পর চার গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন জিয়াউর রহমান, রিফাত যিন সাত্তার, এনামুল হোসেন রাজীব, আব্দুল্লাহ আল রাকিব। চার জন চার রকমের মানুষ। তারা নিজের মধ্যে বাস করেন। সহজে কারো সঙ্গে নিজেকে উন্মুক্ত করেন না। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে- তাদের চার জনের নিবিড় বন্ধুত্ব।

আমি দাবা খেলোয়াড় নই। তবুও এই অতি উচ্চস্তরের দেশের শীর্ষস্থানীয় দাবা খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে—এ বড় ভাগ্যের ব্যাপার। উচ্চস্তরের দাবাড়ুরা দাবার জগতের বাইরে কখনো স্বাছন্দ্য বোধ করেন না। দেশ-বিদেশের খেলোয়াড়রাই এদের বন্ধু।

জিয়ারা এক ধরনের ঘোরের মধ্যে থাকেন। যখন জিয়া আন্তর্জাতিক মাস্টার তখন থেকে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। অনেক টুর্নামেন্ট খেলে, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর জিয়া গ্র্যান্ডমাস্টার তৃতীয় নর্ম অর্জন করে।

এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ দাবা পত্রিকা জানায়, তৃতীয় নর্ম পাওয়ার জন্য জিয়া চৌদ্দবার সুযোগ হারিয়েছে। এমন দেখা যায় না সচারচর।

জিয়া বলতেন, কষ্ট করে নর্ম অর্জনই শ্রেয়। তাহলে খেলাটা শক্তভাবে খেলা যাবে। সহজভাবে গ্র্যান্ডমাস্টার টাইটেল পেয়ে গেলে সেটা রক্ষা করা কঠিন।

জিয়া ইংল্যান্ডে নর্ম করে ঢাকায় ফেরেন। তখন থাকতেন শেখেরটেকে। তার বাবা পয়গাম উদ্দিন আহমদ একজন প্রকৌশলী। জিয়াকে তিনিই তৈরি করেছেন। তার জীবনের ব্যর্থতা জিয়া পূরণ করেছেন।

আমি সেদিন সকাল সকাল জিয়ার বাসায় যাই। তার বাসায় তখন সাংবাদিকদের ভিড়। জিয়া তখন নৃ-তত্ত্ব বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে তখন খুব উৎফুল্ল। জীবনে অনেক পরিশ্রম করে, ত্যাগ করে এই সাফল্য অর্জন করতে হয়েছে।

মনে পড়ে, একবার ঢাকার এক টুর্নামেন্টে লাস্ট রাউন্ডে জিয়ার সঙ্গে খেলা পড়লো গ্রিক এক গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে। সেই রাউন্ডে জিতলে জিয়া গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার প্রয়োজনীয় নর্ম পূরণ করবে। সবার উৎসুক চোখ জিয়ার দিকে।

কিন্তু খুব বাজেভাবে হেরে গেল জিয়া। হাতের সামনে নর্ম অধরাই থেকে গেল। হলরুম থেকে বের হয়ে আমি আর জিয়া রিকশায় উঠলাম। তখনকার দাবা ফেডারেশনের সভাপতি জিয়াকে স্বান্তনা দিলেন। জিয়া সেসব ভ্রুক্ষেপ করল না।

ওর চোখে পানি। শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলল, গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার জন্য কত যে কষ্ট করে যাচ্ছি। হতে পারছি না।

একদিন এক নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে নিরিবিলি বসে জিয়া তার ব্যক্তিগত অনেক কথা জানাল। ওদের মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র স্বপ্ন- জিয়ার গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া।

তারপর একদিন সত্যি সত্যি জিয়া গ্র্যান্ডমাস্টার হলো। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল ক্রীড়াঙ্গনে। জিয়া অনেকবার বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হয়েছেন। এসব ওকে আলোড়িত করে না। দাবার উচ্চতর সাফল্যই ওর ধ্যান জ্ঞান।

এক দুপুরে জিয়ার বাসায় খিচুড়ি খেলাম। তারপর শখের বশে জিয়ার সঙ্গে দাবা খেলতে বসলাম। গ্র্যান্ডমাস্টার বলে কথা! আমার পাশে দাঁড়িয়ে জিয়ার বাবা পয়গাম উদ্দিন আহমেদ আমাকে চাল বলে দিতে লাগলেন। এক পর্যায়ে জিয়া কিছুটা বেকায়গায় পড়ে গেল। জিয়া তখন মহাক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠল, 'এটা ঠিক না বাবা!'

সেদিন বিকেলেই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া উপলক্ষে সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সে খেলা ছিল। জিয়া একা খেলবে একশ প্রতিযোগীর সাথে একই সময়ে। বেশ মজার ব্যাপার। একশ জন গোল হয়ে টেবিলে দাবার বোর্ড সাজিয়ে বসেছে। প্রত্যেকের সামনে একে একে একটা করে চাল দিয়ে যেতে লাগল জিয়া। মজাটা হচ্ছে, সে আমাকে পাশে নিল। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। জিয়া বলল, 'কোনো ব্যাপার না। এগুলো সিরিয়াস খেলা না।' কিছুক্ষণের মধ্যে অধিকাংশ খেলোয়াড় হেরে বিদায় নিল। দু'চার জন কিছুক্ষণ প্রতিরোধ গড়ে তুললো। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই একশ জন ধরাশায়ী।

সেদিন ধানমন্ডি থেকে বের হয়ে জিয়া আর আমি কোথায় যেন কাবাব-রুটি খেলাম। তখন এই মেনু ছিল আমাদের খুব প্রিয়।

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথাসাহিত্যিক আমিরুল ইসলামের বন্ধুত্ব ছিল দীর্ঘদিনের

দুই

সালটা বোধহয় ১৯৯৮। কোনো এক দাবা টুর্নামেন্টে ফাইনাল রাউন্ডে ভারত চ্যাম্পিয়নের সাথে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ান জিয়ার খেলা। আমি তখন দৈনিক বাংলার ফিচার সম্পাদক।

খেলা হবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। দৈনিক বাংলা থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। জিয়া দৈনিক বাংলায় এলো। আমরা রুটি ভাজি খেলাম একসাথে। দুপুর ৩টায় খেলা। কিন্তু জিয়ার নড়াচড়া নাই।

বললাম, 'চলো যাই, আজ না গুরুত্বপূর্ণ খেলা।'

'সেজন্যই একটু দেরি করে যাচ্ছি,' জিয়ার নির্বিকার জবাব। 'এতে প্রতিপক্ষ খানিক ভড়কে যাবে। আমি আজ আত্মবিশ্বাস নিয়ে দ্রুত চাল দেব,' সে বলল।

সেদিন আধঘণ্টা দেরি করে জিয়া উপস্থিত হয়ে খেলা শুরু করে। রুদ্ধশ্বাস খেলা। দশর্কের উপচে পড়া ভিড়। শেষ পর্যন্ত জিয়ার জয়লাভ। টুর্নামেন্টের শিরোপা অর্জন।

জিয়ার অসংখ্য খেলা দাবা ফেডারেশনে আমি সরাসরি দেখেছি। কলকাতায় গিয়েছি অনেকবার জিয়াদের দাবা টুর্নামেন্ট দেখতে। কলকাতার গুড়রিক দাবার কথা মনে পড়ে। জিয়া দাবা কোচ হওয়ার কারণে প্রায়ই কলকাতায় যায়। বেশ কিছুদিন থাকে।

আজকাল অনলাইনে জিয়াদের খেলা দেখতে পাই। ওর খেলার স্টাইল খুব নান্দনিক। ধীরে ধীরে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার কৌশলে খেলে জিয়া।

জিয়া দাবা নিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করত। সাম্প্রতিক সময়ের তাত্ত্বিক দাবার ব্যাপারে আপ টু ডেট থাকতে হয়। কম্পিউটারে সারাক্ষণ দাবা প্রাকটিস করত। অনলাইনে খেলত। দাবা নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটত তার।

জিয়ার স্ত্রী লাবণ্য, তাদের একমাত্র পুত্র তাহসিনের বয়স ১০ বছর। এখনই সে বাংলাদেশের সাত নম্বর দাবারু। তাহসীনের রক্তের মধ্যে দাবা আছে, এই ছোট বয়সেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সে।

জিয়া আর তাহসিন, বাপ-বেটা একসঙ্গে প্রাকটিস করত, দাবা ফেডারেশনে যেত। মাঝে মাঝে বাবা-ছেলের মুখোমুখি খেলা পড়ে যায়। তাহসীনের সঙ্গে ড্র মেনে নেয় জিয়া। তাহসীন বাংলাদেশের সম্ভাবনায় প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যত গ্র্যান্ডমাস্টার।

জিয়ার সঙ্গে স্মৃতিকথার শেষ নেই। তার স্ত্রী লাবণ্য আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। জিয়া-লাবণ্য দুজনেই আমার রান্নার ভক্ত। নিজের বাসা ছাড়াও জিয়া-লাবণ্যর বাসায় বহুবার রান্না করেছি। জিয়া খেতে ভালোবাসত। আড্ডায় মিটি মিটি হাসত। কথা বলত কম। সে একজন শৌখিন গায়কও ছিল। বড় বড় দাবা টুর্নামেন্টের পুরষ্কার বিচরণী অনুষ্ঠানে জিয়াকে গান গাইতে দেখেছি।

জিয়ার সব স্বপ্ন ছিল একমাত্র সন্তান তাহসীনকে ঘিরে। তাহসীন যেন বড় খেলোয়াড় হতে পারে সেই সাধনা ছিল তার। জিয়াই ছিল ওর কোচ।

আধুনিক দাবা অসম্ভব জটিল ও অংকের মতো। প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। থিওরি জানতে হয়। সাম্প্রতিক কলা-কৌশল জানতে হয়।

দাবা পজিশন ও কম্বিনেশনের খেলা। দুটোর সমন্বয় যদি করা যায় তবেই বড় খেলোয়াড় হওয়া যায়। দাবা সবাই জানে অর্থাৎ চাল জানে কিন্তু খেলা জানে না। যারা উচ্চতর দাবা খেলেন তারা প্রফেশনাল। যারা বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলে তারা সেমি প্রফেশনাল আর যারা সাধারণ খেলা খেলেন তারা এ্যামেচার খেলোয়াড়।

দাবা খেলা বুঝতে হলেও অনেক সাধনা করতে হয়। জিয়াদের সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর ধরে চলাফেরা করছি। কিন্তু দাবার কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। দাবার অপার্থিব সৌন্দর্য উপলব্ধি করা হলো না।

দাবা শিল্পের সুষমামন্ডিত খেলা। সঙ্গীতের মতো, চিত্রকলার মতো অলৌকিক এক লেখা।

আর এসবই বুঝতে পেরেছি গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার সুবাদে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জিয়া এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়ার সঙ্গে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান

তিন

গত ৫ জুলাই ঢাকা থেকে যখন কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছালাম, ইমিগ্রেশন পার করে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠা মাত্র ইমরান পরশের ফোন এলো। ফোন করেছে ঢাকা থেকে প্রিয় নাফে নজরুল। দুঃসংবাদটি শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না জিয়া নেই। দাবা ছিল তার প্রাণ দাবার টেবিলেই সে ঢলে পড়েছিল। অপরপ্রান্তে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন আবদুল্লাহ আল রাকিব। জিয়ার অসুস্থতায় ফেডারেশনের সকলেই ছুটে এলেন। তাকে বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হলো মুহূর্তেই। কিন্তু ততক্ষণে প্রাণহীন হয়ে গেছে জিয়া।

আর কোনোদিন জিয়ার সঙ্গে দেখা হবে না। আমার রান্না খাওয়া হবে না জিয়ার। লাবণ্যর হাসি মুখখানা এখন মলিন। জিয়া তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো।

আমীরুল ইসলাম: শিশুসাহিত্যিক

Comments

The Daily Star  | English
Election Commission has proposed stricter amendments to the election law

Fugitives can’t run in national elections

The Election Commission has proposed stricter amendments to the election law, including a provision barring fugitives from contesting national polls.

10h ago