এআই কি সমাজে ধনী দরিদ্রের ফারাক বাড়াচ্ছে

ছোটবেলা থেকেই আমার যন্ত্রের সঙ্গে সখ্যতা। চাইতাম, যন্ত্র যাতে মানুষের কাজ কমানোর কাজে লাগে। ২০১৬ সালে মেশিন লার্নিং নিয়ে যখন প্রথম বই লিখতে বসি তখন মনে হয়েছিল, যন্ত্র কীভাবে মানুষের সহযোগী হতে পারে? ভাবছিলাম, যন্ত্রকে যদি শেখানো যায়, কীভাবে চিন্তা করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাহলেই মানুষের সত্যিকারের সহযোগী হয়ে উঠতে পারে।

আজ ২০২৫ সালে এসে বুঝছি, যন্ত্র শুধু সহকারী নয়, ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে উঠছে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে বড় বড় কোম্পানি, দেশ, বুদ্ধিমান মানুষগুলো ধনী থেকে ধনীতর হয়ে যাচ্ছে।

কারণ কী? এআই ক্লান্ত হয় না, সিক লিভ লাগে না, বেতন বাড়ানোর দরকার হয় না, এমনকি ট্যাক্সও দেয় না। ফলে ব্যবসার খরচ কমছে, লাভ বাড়ছে।

অন্যদিকে সাধারণ মানুষ—যারা কেবল নিজেদের মেধা আর শ্রম বিক্রি করে বাঁচে—তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিন ধনী-গরীবের ফারাক বাড়ছে।

আপনি হয়তো একজন ভালো ড্রাইভার, কিন্তু সেলফ-ড্রাইভিং কার আপনার চাকরি কেড়ে নেবে। আপনি হয়তো কৃষক, কিন্তু এআই-চালিত ফার্মিং সিস্টেম অনেক কম খরচে অনেক বেশি ফসল ফলাবে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, মানুষ আসলে কীভাবে টিকে থাকবে? এই প্রশ্নটাই আমাকে ভাবিয়েছে অনেকদিন।

আমার সেই পুরনো বইয়ে একটা আইডিয়া দিয়েছিলাম—সর্বজনীন ন্যূনতম ভাতা। সহজ করে বললে, আপনি চাকরি করুন বা না করুন, শুধু নাগরিক হওয়ার কারণে একটা নির্দিষ্ট অর্থ রাষ্ট্র থেকে পাবেন। এর ফলে অন্তত খাবার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য—এই বেসিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারবেন। বাকিটা আপনার নিজের হাতে। যতটা ট্যালেন্ট আর ক্রিয়েটিভিটি ব্যবহার করতে পারবেন, ততো আয় করতে পারবেন।

শুনতে সহজ লাগলেও প্রশ্নটা আসে, এই ভাতার টাকা আসবে কোথা থেকে? পৃথিবীর বাতাস, পানি, মাটি, খনিজ এসব আসলে সবার সম্পদ। কিন্তু ইতিহাসের নানা সময়ে এই সম্পদ অল্প কিছু মানুষের হাতে চলে গেছে। ফলে আজ আমরা সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছি না।

ধরুন, যদি বাতাসকে কোনো কোম্পানি প্রাইভেট প্রোপার্টি বানিয়ে ফেলত, আর প্রতিদিন আপনাকে বাতাস কিনে নিতে হতো, তাহলে কি আমরা বাঁচতে পারতাম? ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।

তাহলে সমাধানটা হচ্ছে সহজ, যে সম্পদ থেকে সবাই উপকৃত হওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকেই তহবিল গড়ে তোলা যায়। এআই এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে দেবে।

আগে যেখানে হাজারো কৃষক ঘাম ঝরাত, আজ এআই-চালিত ফার্মিং সিস্টেম সেই কাজ করছে কম খরচে, বেশি দক্ষতায়। প্রশাসন চালাতে যেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ হতো, এআই সেখানে সেই খরচ এক-তৃতীয়াংশ করে দিতে পারে। সাগরের ভেতরে ফার্মিং, খনিজ উত্তোলনের জায়গায় এআই যে বিশাল আয়ের উৎস তৈরি করবে, সেই আয়ের একটা অংশ নাগরিকদের ভাতা হিসেবেই আসতে পারে।

ভাবুন, যদি মাসের শুরুতে সবাই নিশ্চিতভাবে কিছু অর্থ পায়, তাহলে কাজের ধরন কতটা বদলাবে। তখন আর শুধু বেঁচে থাকার জন্য কাজ করতে হবে না। মানুষ তখন নতুন আইডিয়া বের করবে, স্টার্টআপ করবে, মানুষের সাহায্যে নামবে। কেউ হয়তো ছোট একটা দোকান খুলবে, কেউ হয়তো অনলাইন গেম বানাবে। মানুষকে সৃজনশীল হতে বাধা দেবে না ক্ষুধা বা অনিশ্চয়তা।

রাষ্ট্র যদি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে, তাহলে মানুষ রাষ্ট্রের আয় ফিরিয়ে দেবে তার প্রতিভা আর ক্রিয়েটিভিটির মাধ্যমে।

আসল ব্যাপারটা হলো, এআই মানুষকে কেবল কাজ থেকে সরিয়ে দেবে না। বরং এআই আমাদের বাধ্য করবে নতুন একটা সিস্টেম বানাতে, যেখানে বেঁচে থাকার ন্যূনতম গ্যারান্টি থাকবে। এর বাইরে যার ট্যালেন্ট যতো, যার আইডিয়া যতো, সে ততদূর এগিয়ে যাবে।

আমার বিশ্বাস, আমরা যদি এখনই এই প্রসেস নিয়ে চিন্তা না করি, তাহলে এআইয়ের দুনিয়ায় সমাজ ভেঙে যাবে দুভাগে। একপাশে থাকবে এআই ব্যবহার করা অল্প কিছু সুপার ধনী, আরেকপাশে থাকবে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র।

এই বৈষম্যকে কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, সর্বজনীন নুন্যতম ভাতা। কাজ করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল নিয়ে। এটা শুধু অর্থনৈতিক সমাধান নয়, এটা মানুষের স্বাধীনতা আর মর্যাদা রক্ষার লড়াই।


রকিবুল হাসান; টেলিকম, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক এবং লিংক-থ্রি টেকনোলজিস লিমিটেডের চিফ টেকনোলজি অফিসার

Comments

The Daily Star  | English

Only one agreement under Indian line of credit cancelled: Foreign adviser

Touhid says several agreements mentioned in social media discussions 'don't even exist'

1h ago