কেবল ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই বিসিবি নির্বাচন?

মঞ্চ ছিল প্রস্তুত, ভোটাররাও ছিলেন প্রস্তুত। তবে আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচন ঘিরে উচ্ছ্বাস নয়, বরং একঘেয়েমি আর বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তির অনুভূতিই যেন বেশি।

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এই বোর্ডে পরবর্তী চার বছরের জন্য পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আবারও। কিন্তু প্রক্রিয়াটি যতটা না গণতান্ত্রিক চর্চার, তার চেয়ে বেশি যেন সাজানো একটি নাটকের মতো, যেখানে নিয়ন্ত্রণ ও বিতর্কই মুখ্য চরিত্র।

গত ২১ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিতর্কের ঘূর্ণিপাক শুরু হয়। সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ, কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব ও বিসিবির সংবিধানের নানা ফাঁকফোকর— সব মিলিয়ে প্রক্রিয়াটি জটিল ও বিতর্কিত হয়ে ওঠে।

যা হতে পারত সংস্কারের সুবর্ণ সুযোগ, তা আবারও পরিণত হয়েছে পুরনো খেলার পুনরাবৃত্তিতে— যেখানে নীতির ওপরে ক্ষমতার প্রাধান্য ও সততার ওপর প্রভাবের প্রাধান্য।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অনেকে আশা করেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এবার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিসিবিতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার আনবে— যাতে প্রকৃত ক্রিকেট সংগঠকরা বোর্ডে ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু সেই আশা এখন প্রায় নিভে গেছে। স্বচ্ছতা আনার বদলে এই নির্বাচন বরং উন্মোচন করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসনের পুরনো দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি।

সবচেয়ে আগে বিতর্ক ওঠে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে। অভিযোগ ছিল, কয়েকটি মনোনয়ন 'ম্যানিপুলেট' করা হয়েছে এবং জমা দেওয়ার সময়সীমা দুইবার বাড়ানো হয়েছে।

সমস্যা নিহিত বিসিবির সংবিধানেই— যেখানে বলা আছে, 'যদি' কোনো জেলাতে জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন না থাকে, তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থা কাউন্সিলর মনোনয়ন দিবে। এই 'যদি' শব্দটিই বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করেছে।

এরপর আসে ক্লাবগুলো। সব সময়ের মতো এবারও বোর্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ এই ক্লাব প্রতিনিধিরা। ২৫ জন পরিচালকের মধ্যে ১২ জনই আসে ঢাকা মহানগরের ক্লাবগুলো থেকে। অন্য কোনো বড় ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে ক্লাবগুলোর এমন আধিপত্য নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ক্লাব রাজনীতি এখন বিসিবির মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতা দূর করার প্রতিটি প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে। কারণ, এতে যাদের লাভ হয়, তারাই পরিবর্তনের পথে বাধা দেয়।

স্ববিরোধিতার এখানেই শেষ নয়। বোর্ড কর্মকর্তারা একদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছেন, অন্যদিকে বিসিবির নিজস্ব সংবিধান সেই হস্তক্ষেপের পথ খুলে দেয়। কারণ, এতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে (এনএসসি) সরাসরি দুজন পরিচালক মনোনয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সরকারের ওপর এই কাঠামোগত নির্ভরতা বোর্ডকে সব সময় রাজনৈতিক প্রভাবের আওতায় রাখে।

একসময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলকে (আইসিসি) দেওয়া প্রতিশ্রুতি— যা বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেট পরিচালক এডি বারলোর হাতে লেখা নোটে উল্লেখ করা ছিল— যে আঞ্চলিক অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে, তা বহু আগেই স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে গেছে। ২৫ বছর পরও সব কিছু ঢাকাকেন্দ্রিক এবং কাঠামো রয়ে গেছে অপরিবর্তিত।

অন্তর্বর্তী সরকার— যাদের কাছ থেকে স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি ছিল, তারাও ব্যর্থ হয়েছে। তাই অভিজ্ঞ সংগঠকরা হতাশ। কারণ, তাদের চোখে এই নির্বাচন ন্যায়বিচারের নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত রীতির পুনরাবৃত্তি।

মোট ১৫৭ জন ভোটার আজ ২৮ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে ১৭ জন পরিচালক নির্বাচিত করবেন। ছয় জন আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বোর্ড গঠনের পর সভাপতি ও সহ-সভাপতিদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে বড় কোনো চমক আশা করছেন না কেউ।

বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল— যিনি ঢাকা বিভাগ থেকে পরিচালক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন— তিনি আবারও বোর্ডের শীর্ষ পদে বহাল থাকবেন বলে জোরাল ধারণা রয়েছে। তার পথ আরও সহজ হয়েছে সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালসহ কয়েকজন প্রভাবশালী প্রার্থী 'রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্র'-এর অভিযোগ তুলে নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোয়।

এবারের নির্বাচনে বড় বিতর্ক দুটি। প্রথমত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে বুলবুলের পাঠানো চিঠি। সেখানে তিনি স্বীকার করেন যে, কয়েকটি জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা যথাযথভাবে কাউন্সিলর মনোনয়ন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এরপরই সময়সীমা বাড়ানো ও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ওঠে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা মহানগরের ১৫টি ক্লাব নিয়ে টানাপোড়েন— যাদের কাউন্সিলর পদ স্থগিত, পুনর্বহাল ও আবার স্থগিত— এভাবে এক সপ্তাহে তিন দফা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। এর মধ্যেই প্রতিবাদ ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মতো ঘটনা ঘটে।

এমনকি গতকালও এই নাটকের আরেকটি পর্ব মঞ্চস্থ হয়। সুপ্রিম কোর্টের একজন চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে শেষ মুহূর্তে সেই ১৫টি ক্লাবের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেন। ফলে নির্বাচন কমিশনকে ব্যালট পেপার পুনর্মুদ্রণ করতে হয়।

তবে ক্ষতি যা হওয়ার, তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট আবারও আটকে পড়েছে সেই চিরচেনা আবর্তে— একটি নির্বাচন, যা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত একই জীর্ণ ও ভঙ্গুর ব্যবস্থারই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English

Tug-of-war over water lily continues

The Election Commission and National Citizen Party remain locked in a heated debate over the party’s choice of electoral symbol, the water lily -- a dispute that began in June.

5h ago