ড্রেসিং রুমের রাজনীতিতে পরাজিত আলোনসো!
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সেই বিকেলে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের বিস্ফোরণ শুধু এক মুহূর্তের আবেগ ছিল না, এটি ছিল জাবি আলোনসোর গড়ে তোলা রিয়াল মাদ্রিদের প্রকল্পে গভীর একটি ফাটল। সেই বদলি হওয়ার ক্ষোভ, সবার সামনে তার প্রতিক্রিয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর ক্লাবের নীরবতা, যা আলোনসোর কর্তৃত্বকে মুহূর্তেই দুর্বল করে দিয়েছে।
মৌসুমের শুরুতে ১৪ ম্যাচে ১৩ জয় এনে এক নতুন পরিচয় গড়তে শুরু করেছিলেন আলোনসো; কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা ও দৃঢ়তা ভেঙে পড়ে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে, যখন ক্লাব কোচের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।
কার্লো আনচেলোত্তি–জিনেদিন জিদান যুগের শান্ত, হায়ারার্কিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা থেকে ক্লান্ত হয়ে রিয়াল মাদ্রিদ চেয়েছিল এক নতুন প্রজন্মের আধুনিক কোচ। আর্সেনালের মিকেল আর্তেতার মতো পরিচ্ছন্ন দর্শনের একটি দল, যাদের খেলার ধরন স্পষ্ট, কৌশল নির্দিষ্ট ও গঠন আধুনিক।
লেভারকুসেনকে চ্যাম্পিয়ন বানানো, অজানা খেলোয়াড়দের বিশ্বমানের তারকায় পরিণত করা এই বাস্ক কোচ আলোনসো সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন দৃঢ় নীতিতে। তিনি ড্রেসিং রুমকে বদলাতে এসেছেন, তার কাছে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নয়।
রিয়ালে এসেই ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপে আলোনসো দেখিয়ে দেন তিনি কী চান। একটি বহুমুখী, দ্রুত চাপ প্রয়োগকারী, শৃঙ্খলিত দল। এর মূল ছিল একটি বিষয়: সকলের সম্মিলিত দৌড় ও পরিশ্রম। এর জন্য প্রথম কাজ ছিল দলকে কিলিয়ান এমবাকেকে কেন্দ্র করে সাজানো। তার চারপাশে এমন খেলোয়াড় চাই যারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবে।
এ সময় আলোনসোর সবচেয়ে কঠোর বার্তা ছিল ভিনিসিয়ুসের দিকে, খেলতে চাইলে দৌড়াতে হবে, রক্ষণের কাজেও অংশ নিতে হবে। ফলাফল -ভিনি বারবার বেঞ্চে। আর রিয়াল? জিতে যাচ্ছিল। জুড বেলিংহাম ছিলেন ইনজুরিতে, তাতেও দলের ভারসাম্য নষ্ট হয়নি। আর্দা গুলার হয়ে ওঠেন মূল কেন্দ্রে, আর শুরুতেই রিয়াল ১৪ ম্যাচে ১৩ জয় তুলে নিয়ে মৌসুমের সেরা সূচনার একটিতে পৌঁছে যায়।
মাস্তানতুয়োনো, ব্রাহিম দিয়াজ, রদ্রিগো সবাই আলোনসোর হাই প্রেসিংয়ে দারুণ মানিয়ে নেন। তরুণ মাস্তানতুয়োনো তো ছিলেন আলোনসোর চোখের 'মিডফিল্ড সৈনিক'। বিশ্বস্ত, পরিশ্রমী, শৃঙ্খলিত ও আজ্ঞাবহ।
তবে সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে দলে অসন্তোষও বাড়তে থাকে। তারকাদের ড্রেসিং রুম সবসময়ই সংবেদনশীল; ভিনিসিয়ুস, বেলিংহাম ও ভালভার্দেকে অনেক বেশি ভিডিও সেশন, কৌশলগত বিশ্লেষণ এবং বাড়তি পরিশ্রম ক্লান্ত করে তুলছিল। এই অসন্তোষ ধীরে ধীরে রূপ নেয় কোচ-খেলোয়াড়দের ঠান্ডা যুদ্ধে। যেখানে নীরবতা স্টেডিয়ামের ভেতর থেকেও ভয়ংকর হতে পারে।
এই যুদ্ধ চূড়ান্ত আকার পায় ক্লাসিকোর সেই দিন। ২০ মিনিট বাকি থাকতে ভিনিসিয়ুসকে আলোনসো তুলে নিলে ব্রাজিলিয়ান তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। প্রকাশ্য ক্ষোভ দেখান, এবং বিশ্ব ফুটবল সেই মুহূর্তে এক বিভক্ত রিয়ালকে দেখতে পায়। এরপর ক্লাবের উচিত ছিল শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা নেওয়া, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কোচকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়। সেদিনই আলোনসোর ক্ষমতার ভিত্তি নড়ে যায়, কারণ তারকারা বুঝে যায় কোচ একা। এখন তারা যা চাইবে, সেটাই নিয়ম।
এরপর থেকেই রিয়াল বদলাতে থাকে। হাই প্রেসিং কমে যায়, ব্রাহিম ও মাস্তানতুয়োনো দল থেকে হারিয়ে যান, ভিনিসিয়ুস-বেলিংহাম হয়ে ওঠেন 'অস্পর্শ্য', আর আলোনসো ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেন তার প্রাথমিক কঠোরতা। তিনি যে প্রকল্প নিয়ে শুরু করেছিলেন, যেখানে সবাই নাম-পরিচয় ভুলে সমানভাবে দৌড়াবে, সেটি বদলে যায় তারকা-সমঝোতার ফুটবলে। আলোনসো আর কৌশলগত কোচ নন, হয়ে ওঠেন কেবল 'ইগো ম্যানেজার', যা তিনি কখনো হতে চাননি।
শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে লড়াই আলোনসো শুরু করেছিলেন, সেটি খেলোয়াড়রাই জিতে ফেলেছে। কারণ ক্লাব সেই লড়াইয়ে কোচের পাশে দাঁড়ায়নি। রিয়াল আবার সেই পরিচয়হীন অবস্থায় ফিরে গেছে, যেখানে তারকাদের ইচ্ছেই দলের নীতি ঠিক করে। আর জাবি আলোনসো আজ দাঁড়িয়ে আছেন এক যন্ত্রণার মাঝে। তার আধুনিক ফুটবলদর্শন ও রিয়ালের শক্তিশালী ড্রেসিং রুম রাজনীতির সংঘর্ষবিন্দুতে।
সূত্র: মার্কা


Comments