হামজা ও ফুটবলের ঘরে ফেরার বছর
২০২৫ সালে বাংলাদেশ এক নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী হয়েছে—এমন এক প্রত্যাবর্তন, যা কয়েক বছর আগেও ছিল অকল্পনীয়।
অগণিত মানুষের প্রিয় এক ফুটবলার বিশাল প্রত্যাশার ভার নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছেন বাংলাদেশে। তার আগমন সংবাদপত্রের শিরোনাম কেড়ে নিয়েছে, টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছে; সাধারণ মানুষকে যুগিয়েছে পরিবর্তনের মশাল জ্বালানোর প্রেরণা।
না, আলোচিত ব্যক্তিটি কয়েকদিন আগে দেশে ফেরা কোনো হাই-প্রোফাইল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন; তিনি হামজা চৌধুরী।
লেস্টার সিটির এই মিডফিল্ডার জাতীয় দলের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে মার্চ মাসে বাংলাদেশে আসেন। তিনিই হয়ে ওঠেন সেই অনুঘটক, যার হাত ধরে ফুটবলের সঙ্গে এদেশের মানুষের ঝিমিয়ে পড়া প্রেম নতুন করে জেগে ওঠে। ২০২৫ সালটি তাই চিহ্নিত হয়ে থাকবে সেই বছর হিসেবে, যখন বাংলাদেশ আবারও 'ফুটবলময়' হয়ে উঠেছিল।
ফলাফলের বিচারে হামজার আগমন খুব বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি। পুরুষ জাতীয় দল তাদের আট ম্যাচের মাত্র দুটিতে জিতেছে; অনুমিতভাবেই এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে লাল-সবুজরা। সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিপক্ষে লড়াকু ফুটবল উপহার দিয়েও হারতে হয়েছে সামান্য ব্যবধানে। তবে বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ১৮ নভেম্বর। সেদিন ঢাকায় ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে দীর্ঘ ২২ বছরের খরা কাটায় বাংলাদেশ।
মাঠের স্কোরকার্ড যা-ই বলুক, বাংলাদেশ ফুটবল দল এমন কিছু করতে পেরেছে যা গত বহু বছরে দেখা যায়নি—তা হলো মানুষের মনে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা।
সমর্থকদের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো। মিনিটের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে জাতীয় স্টেডিয়ামের টিকিট। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে গ্যালারি পূর্ণ করে উল্লাস আর হৃদয়ভঙ্গের প্রতিটি মুহূর্তে খেলোয়াড়দের পাশে ছিলেন তারা। কোচ হাভিয়ের কাবরেরার দল নির্বাচন নিয়ে যেমন হয়েছে কড়া সমালোচনা, তেমনি প্রবাসী ফুটবলারদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতেও সোচ্চার ছিল ভক্তরা।
পুরানো প্রজন্মের কাছে ফিরে এসেছিল সেই সোনালী দিনের স্মৃতি, যখন ফুটবলই ছিল দেশের এক নম্বর খেলা। আর তরুণরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এমন এক দল নিয়ে, যাদের নিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্ব করা যায়।
এই পরিবর্তনের মুখ হামজা চৌধুরী। প্রতিটি ম্যাচে নিংড়ে দিয়েছেন নিজের সবটুকু। তার এই লড়াকু মানসিকতা জয় করে নিয়েছে ভক্তদের হৃদয়। তার হাত ধরেই খুলে গেছে নতুন দুয়ার; শমিত সোম, ফাহমেদুল ইসলাম ও জায়ান আহমেদের মতো প্রবাসীরাও নাম লিখিয়েছেন জাতীয় দলে।
পুরুষ দল যখন প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাচ্ছিল, ঠিক তখন মাঠের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি এসেছে নারী ফুটবলের হাত ধরে। টানা দুবার সাফ জেতার পর, জুন-জুলাইয়ে প্রথমবারের মতো এএফসি ওম্যান'স এশিয়ান কাপের টিকিট কাটে বাংলাদেশ। ঋতুপর্ণা চাকমা-মারিয়া মান্ডারা র্যাঙ্কিংয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা দলগুলোকে হারিয়ে এই ঐতিহাসিক গৌরব বয়ে আনেন।
এই এক বছরে ফুটবলের প্রতি মানুষের ঝোঁক এতটাই ছিল যে, ক্রিকেটের একচ্ছত্র আধিপত্য হুমকির মুখে পড়ে। অন্যদিকে মাঠের বাইরে অস্থিরতায় কেটেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের। বোর্ড নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে নারী ক্রিকেটার জাহানারা আলমের যৌন হয়রানির অভিযোগ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিল টালমাটাল। মাঠের পারফরম্যান্সেও হতাশ করেছে পুরুষ ও নারী ক্রিকেট দল।
ক্রিকেটের তুলনায় বাংলাদেশ নজর কেড়েছে হকি, আর্চারি ও টেনিসের মতো খেলাগুলোতে। অনূর্ধ্ব-২১ হকি দল জুনিয়র ওয়ার্ল্ড কাপে 'চ্যালেঞ্জার ট্রফি' জিতেছে। আর্চাররা এশিয়া কাপ ও এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতেছে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেনিসে আইটিএফ ওয়ার্ল্ড ট্যুর জুনিয়র্স শিরোপা জিতেছেন জারিফ আবরার। ব্রোঞ্জ এসেছে নারী কাবাডি দল থেকেও।
সব মিলিয়ে ২০২৫ সালের দিকে তাকালে হামজা চৌধুরীর আগমন আর নারী দলের এশিয়ান কাপে উত্তরণই হবে বছরের সেরা প্রাপ্তি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় এশিয়ান কাপ আর জুনে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। সব মিলিয়ে ২০২৬ সালও হতে পারে ফুটবলেরই বছর।

Comments