সার্বিয়ায় জোকোভিচ: নায়ক থেকে 'দেশদ্রোহী'

সার্বিয়ার জাতীয় গর্ব, ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে বড় নায়ক, জনগণের অন্যতম প্রেরণা নোভাক জোকোভিচ। ২৪টি গ্র্যান্ডস্ল্যাম শিরোপাজয়ী নোভাক জোকোভিচকে সবাই ডাকে দেশের সেরা দূত কিংবা জাতির সোনার যোদ্ধা। কিন্তু সেই জোকোভিচই এখন প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার ভুচিচের ঘনিষ্ঠ মহল ও সরকারপন্থী গণমাধ্যমে পরিচিত হচ্ছেন 'দেশদ্রোহী' হিসেবে। কারণ, প্রকাশ্যে দুর্নীতি বিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এই টেনিস তারকা।

গল্পের শুরু গত বছরের নভেম্বরে। সার্বিয়ার নোভি সাদ শহরে ট্রেনস্টেশনের একটি বাসস্টপ ধসে পড়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং আইনের শাসনের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। কিন্তু ভুচিচ সরকার আন্দোলনকে বিদেশি শক্তির প্ররোচিত 'কালো বিপ্লব' বলে অভিযুক্ত করে এবং আন্দোলনকারীদের আখ্যা দেয় রাষ্ট্রদ্রোহী ও শত্রু হিসেবে।

ডিসেম্বরে জোকোভিচ প্রথমবার প্রকাশ্যে কথা বলেন নোভি সাদের ওই দুর্ঘটনা নিয়ে। জানুয়ারিতে এক ম্যাচ জয়ের পর তিনি বিজয় উৎসর্গ করেন আন্দোলনে আহত এক শিক্ষার্থীর প্রতি। পরে বেলগ্রেডে একটি বাস্কেটবল ম্যাচে তাকে দেখা যায় এমন এক সোয়েটশার্ট পরে, যেখানে লেখা ছিল, 'শিক্ষার্থীরাই চ্যাম্পিয়ন।' মার্চ মাসে প্রায় তিন লাখ মানুষ যখন বেলগ্রেডের রাস্তায় নেমে ভুচিচ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে, জোকোভিচ নিজের সামাজিক মাধ্যমে সেই বিক্ষোভের ছবি শেয়ার করে লিখেছিলেন, 'ঐতিহাসিক, মহিমান্বিত! সার্বিয়ার সম্ভাবনা অসীম, আর শিক্ষিত তরুণরাই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের যা প্রয়োজন, তা হলো বোঝাপড়া ও সম্মান।'

এমনকি সাম্প্রতিক উইম্বলডন জয়ের পরও আন্দোলনের ছায়া এসে পড়ে তার উদযাপনে। ফাইনাল জয়ের পর তিনি আন্দোলনকারীদের স্লোগান অনুকরণ করে উদযাপন করেন, যার মূল বক্তব্য ছিল সরকারকে চাপে রাখা। জোকোভিচ অবশ্য দাবি করেছেন, এই উদযাপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং সন্তানদের খুশি করার জন্য ছিল। কিন্তু সরকারপন্থী গণমাধ্যম ইনফরমের তখন থেকেই তাঁকে আখ্যা দিতে শুরু করে 'লজ্জাজনক', 'সহিংসতার সমর্থক' এবং 'ভুয়া দেশপ্রেমিক'। বিশ্লেষক ইভান প্রোতিচ অবশ্য বলছেন, সরকারঘনিষ্ঠ গণমাধ্যম সমালোচকদের আক্রমণ করতে গিয়ে সার্বিয়ার ভেতরে-বাইরে একটি মিথ্যা চিত্র দাঁড় করাচ্ছে।

অগাস্টে নতুন আরেকটি ধাক্কা আসে জোকোভিচের পরিবারে। তাদের আয়োজিত টেনিস প্রতিযোগিতা 'বেলগ্রেড ওপেন' এ বছর আর অনুষ্ঠিত হচ্ছে না সার্বিয়ার রাজধানীতে। আয়োজকরা ঘোষণা দেয়—প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি, তাই প্রতিযোগিতা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে। যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে অংশ নেওয়ার সময় সাংবাদিকদের জোকোভিচ বলেন, সবসময়ই ইচ্ছে ছিল টুর্নামেন্ট বেলগ্রেডেই রাখার, কিন্তু আয়োজক হিসেবে তার ভাই হোর্হে বাধ্য হয়ে স্থান পরিবর্তন করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি অনুকূল হলে প্রতিযোগিতা আবার ফিরবে সার্বিয়ার রাজধানীতে।

এর মধ্যেই পাল্টা প্রচারণায় নামে ভুচিচ সরকার। এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট ভুচিচ নাগরিকদের লেখা কিছু চিঠি পড়ে শোনাচ্ছিলেন। একটি শিশুর চিঠিতে লেখা ছিল, 'আমি সার্বিয়াকে ভালোবাসি, আমি বিশ্বের সেরা টেনিস খেলোয়াড় নোভাক জোকোভিচকে দেখি।' কিন্তু তিনি সেটি পরিবর্তন করে পড়ে শোনান—"আমি বাস্কেটবল খেলি, ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা দেখি, আমি নিকোলা জোকিচকে ভালোবাসি। সার্বিয়া দীর্ঘজীবী হোক!'

অথচ এর আগে একই ভুচিচই বলতেন, 'নোভাক আমাদের জনগণের গর্ব, সার্বিয়ার সেরা রাষ্ট্রদূত। তার প্রতিটি জয় মানে সার্বিয়ার জয়।' আবার ট্যাবলয়েড সংবাদপত্রগুলো যেমন কুরির, আলো, ব্লিৎস কিংবা টেলিগ্রাফ তাকে বর্ণনা করত 'হাঁটতে থাকা সাধু', 'জাতির সোনার যোদ্ধা', 'সর্বকালের সেরা' বা 'সার্বিয়ান প্রতিভা' হিসেবে।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর পরেই সেই প্রশংসা বদলে গেছে অভিশাপে। এখন তাকে বানানো হচ্ছে 'দেশদ্রোহী' বা 'অখ্যাত খেলোয়াড়।' বিশ্লেষক প্রোতিচ মনে করিয়ে দেন, সার্বিয়ার সব সরকারই অতীতে ক্রীড়াবিদদের সাফল্যকে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ব্যবহার করেছে। অথচ কোনো খেলোয়াড় যদি সরকারের বিপক্ষে যায়, এমনকি নোভাক জোকোভিচের মতো বিশ্বতারকাকেও এক মুহূর্তেই তুচ্ছ করে দেওয়া হয়, মুছে ফেলা হয় তার কীর্তি, আর নতুন করে চাপিয়ে দেওয়া হয় এক পরিচয়, 'দেশদ্রোহী।'

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

2h ago