দুর্গম চরের ‘আশার আলো’

চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়
ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে দুর্গম চর ভগবতীপুর। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের এই দুর্গম চরে প্রায় ৫০০ পরিবারের বাস। এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩টি মাদ্রাসা আছে। ছিল না উচ্চ বিদ্যালয়। তাই প্রাথমিকের পর এই চরের শিক্ষার্থীদের আর পড়াশুনা হতো না।

সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই চরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়'।

গত জানুয়ারি থেকে বিদ্যালয়ের পাঠদান শুরু হয়েছে।

ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন ১৩০ শিক্ষার্থী। পড়াচ্ছেন ৪ শিক্ষক। চরের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে আশার আলো জাগিয়েছে এই বিদ্যালয়টি।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রে নদের বুকে প্রায় ৪০০ চর আছে। প্রত্যেক চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থাকলেও এতগুলো চরের মধ্যে ৬টিতে উচ্চ বিদ্যালয় আছে।

জেলা প্রশাসনের উদ্যেগে সপ্তম উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চর ভগবতীপুরে।

'অধিকাংশ চরে উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি' উল্লেখ করে চর পার্বতীপুর এলাকার কৃষক আজগর আলী (৫০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রাথমিক পাস করার কয়েকদিন পর ২ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এক ছেলে প্রাথমিক পাসের পর খেতে কাজ করছে। ছোট ছেলে গত বছর প্রাথমিক পাস করেছে।'

চরে নতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে ছোট ছেলেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করেছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'চরে উচ্চ বিদ্যালয়টি বানানো না হলে ছোট ছেলের পড়াশুনা আর এগোতো না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছোট ছেলেকে কলেজ পর্যন্ত পড়াবো।'

'এই চরে উচ্চ বিদ্যালয় থাকলে আমার বাকি ৩ ছেলে-মেয়েকে কলেজে পড়ানোর সুযোগ পেতাম,' যোগ করেন তিনি।

চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়
ব্রহ্মপুত্রের বুকে চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

একই চরের কৃষক নয়া মিয়া (৬০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চর থেকে মূল ভূখণ্ডে গিয়ে পড়াশুনা করা ছেলে-মেয়েদের জন্য কষ্টকর। ব্যয়বহুলও। তাই এখানে ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিকের পর আর পড়াশুনা করতো না।'

'আমাদের চরে নতুন উচ্চ বিদ্যালয় হয়েছে। আমাদের মাঝে আশার আলো জাগিয়েছে। এখন ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে।'

'এই বিদ্যালয় আমাদের জন্য আশীর্বাদ,' মন্তব্য করেন তিনি।

ষষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থী কোহিনুর আক্তার ডেইলি স্টারকে বলে, 'চরে উচ্চ বিদ্যালয় না হলে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যেত। এখন আমি উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছি। বাবা-মাও আমাকে উচ্চশিক্ষিত করতে আগ্রহী।'

চরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকায় তার বড় ২ বোনের বিয়ে হয়েছে বলে সে জানায়।

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোজিনা আক্তার ডেইলি স্টারকে বলে, 'মূল ভূখণ্ড যাত্রাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সপ্তাহে একদিন স্কুলে যেতাম। আমাদের চরে উচ্চ বিদ্যালয় হওয়ায় এখানে ভর্তি হয়েছি। নিয়মিত স্কুলে আসছি।'

বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির আজীবন সদস্য ইউসুফ আলমগীর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চর ভগবতীপুর ছাড়া পার্শ্ববর্তী চর পার্বতী, পোড়ার চর, মাঝের চরসহ বেশ কয়েকটি চরের শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীই বেশি। চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াতে ভূমিকা রাখবে।'

'বিদ্যালয়ে নিয়মিত লেখাপড়ার বিষয়ে আমরা নজর রাখছি,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'প্রশাসনের সহযোগিতায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছি। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৪টি শ্রেণিকক্ষ আছে। ধীরে ধীরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে।'

স্কুলের শিক্ষক ফারুক আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বেচ্ছাশ্রমে পড়াচ্ছি। চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো জ্বালাতে নিবেদিত আছি। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের স্থান সংকুলান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবকাঠামো আরও বাড়ানো প্রয়োজন।'

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছি। পাঠদানের অনুমতির জন্য কাগজপত্র তৈরি করা হচ্ছে। অনুমতি পেলে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।'

'বিদ্যালয়টি যাতে দ্রুত এমপিওভুক্ত করা যায় সে বিষয়েও চেষ্টা করবো।'

চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেদুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের আর্থিক সহায়তায় বিদ্যালয়টির জন্য ৪টি রুমে চরের জন্য উপযোগী টিনশেড ঘর করা হয়েছে। শিক্ষকদের সম্মানী ও বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আর্থিক তহবিল গঠন করা হয়েছে। সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, কুড়িগ্রাম পৌরসভার মেয়রসহ অনেকেই সহযোগিতার করেছেন। সবার পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্কুলটি আরও প্রসারিত হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Ocean of mourners gather to pay tribute to Khaleda Zia

Crowds spilled over into surrounding areas, with large gatherings seen in Farmgate, Karwan Bazar and nearby localities

2h ago