২০২৫: বিক্ষোভ ও অব্যবস্থাপনায় বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা

ফাইল ছবি। স্টার

নরসিংদীর একটি গ্রামে বসবাস করেন আহমেদ মিয়া। তার মেয়ে রাফিয়া স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি শেষ করেছে, অথচ এখনো সে ঠিকভাবে বাংলা পড়তে পারে না।

বাখরনগরের বাসিন্দা আহমেদ বলেন, 'এখানে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে, কিন্তু অনেকেই ঠিকভাবে পড়তে পারে না।'

পাশের গ্রাম সাতপাড়ায় সোনিয়া আক্তার শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, স্কুলের শ্রেণিকক্ষ ফাঁকা থাকলে সেই জায়গা ধীরে ধীরে দখল নেবে স্থানীয় কারখানা ও বাল্যবিয়ের তালিকা। তার মতে, স্কুল বন্ধ থাকলে ছেলেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে, আর মেয়েদেরও অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।

এই আশঙ্কাগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের জন্য ২০২৫ সাল ছিল অত্যন্ত অস্থির ও সংকটপূর্ণ বছর। এই বছর শিক্ষা ব্যবস্থার পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ধরনের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব স্তরেই দীর্ঘ শিক্ষক আন্দোলন, সরকারের কঠোর দমননীতি এবং পাঠ্যক্রম নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে নিয়মিত পড়াশোনা ও পরীক্ষার সময়সূচি প্রায় ভেঙে পড়ে।

সংকটের শুরু হয় জানুয়ারিতেই এবং খুব দ্রুত তা বড় আকার নেয়। বেতন বাড়ানোর দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে শাহবাগের দিকে পদযাত্রা করতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়।

মে মাসে এই আন্দোলন দেশজুড়ে ধর্মঘটে রূপ নেয়। এতে দেশের ৬৫ হাজার ৫৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার শিক্ষক কর্মবিরতিতে যান এবং এক কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী স্কুলে যায়নি।

সরকার সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রস্তাব দিলেও শিক্ষকরা তা মানেননি। পরে সাময়িকভাবে একটি সমঝোতা হলেও তা গ্রীষ্মের ছুটি পর্যন্তও টেকেনি।

সংকট শুধু প্রাথমিক শিক্ষায় সীমিত ছিল না। অক্টোবর মাসে এমপিওভুক্ত স্কুল–কলেজের শিক্ষকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনে নামেন। তাদের দাবি ছিল খুবই সাধারণ—মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা দেওয়া, কারণ বছরের পর বছর ধরে তারা মাত্র এক হাজার পাঁচশ টাকা পাচ্ছেন।

এই আন্দোলনে সরকারের আচরণ ছিল কঠোর। পুলিশ জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিচার্জ করে। এতে শতাধিক শিক্ষক আহত হন। নভেম্বর মাসে প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের সময়ও একই ধরনের কঠোরতার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়।

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষকদের পেছনে বিনিয়োগ খুবই কম। যখন ন্যূনতম আর্থিক দাবিও উপেক্ষিত হয়, তখন আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, অন্যান্য স্বার্থগোষ্ঠীর দাবি শান্তিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়া হলেও শিক্ষকদের রাস্তায় মারধর করা হয়েছে—যা এক ভয়াবহ দ্বিচারিতার উদাহরণ।

রাস্তায় যখন আন্দোলন ও অস্থিরতা চলছিল, তখন স্কুলের ভেতরেও ছিল বড় ধরনের গড়মিল। বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা সময়মতো পাঠ্যবই পায়নি, কারণ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যথাসময়ে বই বিতরণে ব্যর্থ হয়। পরে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে সরকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

আগস্টে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হলেও তিন মাসের মধ্যেই হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামপন্থী সংগঠনের চাপের মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। রাশেদা চৌধুরীর মতে, এটি সরকারের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং এতে রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক শিক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে সাংঘর্ষিক বার্তা দেয়।

শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে খারাপ চিত্র দেখা যায় পরীক্ষার ফলাফলে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার নেমে আসে ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশে, যা গত বিশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলও ছিল গত ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।

কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে যেভাবে বাড়তি নম্বর দেওয়া হতো, তা বন্ধ হওয়াতেই ফল খারাপ হয়েছে। কিন্তু রাশেদা চৌধুরীর মতে, এটি হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়; বরং দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা খাতে অবহেলার ফলে তৈরি হওয়া শিক্ষাগত ঘাটতির বাস্তব প্রতিফলন।

শিক্ষা খাতে সরকারের আগ্রহ কম—এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাজেটেও। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি কমানো হয়েছে। মোট বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ।

তবে এই বিশৃঙ্খল বছরের ক্ষতি শুধু সংখ্যায় বোঝা যায় না। ২১ জুলাই উত্তরা এলাকায় একটি স্কুলে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ জেট বিধ্বস্ত হয়ে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকও ছিলেন। পাশাপাশি নরসিংদীর রাফিয়ার মতো অনেক শিশু ধীরে ধীরে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ছে বলে সতর্ক করেন রাশেদা চৌধুরী।

এই বিষয়ে জানতে প্রতিবেদক গত কয়েক দিনে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

তবে সব অস্থিরতার মধ্যেও একটি ইতিবাচক দিক দেখা গেছে। দীর্ঘদিন পর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরসহ চারটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

যদিও এতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মতপ্রকাশের পরিসর কিছুটা খুলেছে, তবু তা পরীক্ষা বাতিল, শিক্ষক নিপীড়ন ও চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে তীব্র বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থাকে রাশেদা কে চৌধুরী 'ভিন্নমত শোনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ব্যর্থতা' বলে অভিহিত করেন।

মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখা একটি দেশের জন্য ২০২৫ সালে শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট একটি বড় সতর্কবার্তা। সরকার যদি সময়মতো ও সঠিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে না পারে, তবে দেশের জনসংখ্যাগত সুবিধা ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।

Comments