মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রকাশনা জগত যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন

মহিউদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রকাশক, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো, ইমেরিটাস প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ মারা গেছেন গত বছর ২২ জুন।

অনেক গুণের অধিকারী প্রকাশক খুব কমই দেখা যায়। তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রধানত গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করে থাকে৷ তিনি বাংলাদেশি লেখক ছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদদের রচিত গবেষণা প্রকাশ করেছেন৷

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' প্রকাশ ও বিশ্বব্যাপী প্রচারেও মহিউদ্দিন আহমেদের ভূমিকা অনবদ্য।

প্রকাশনার পাশাপাশি তিনি নিজেও লেখক। সম্পাদনা করেছেন ইউপিএল থেকে প্রকাশিত সমকালীন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের সংকলন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে প্রকাশনাকেই তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। আর তা দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে দেশের ইতিহাস সঠিক ও পর্যাপ্ত রূপে সংরক্ষণের অভাব অনুধাবন করে 'রোড টু বাংলাদেশ' নামে একটি ধারাবাহিক প্রকাশনা করেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রকাশিত বই যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করার মাধ্যমে এই ২ দেশের মধ্যে সে সময় পর্যন্ত বিদ্যমান একমুখী এই ব্যবসাকে তিনি বিপরীত দিকে চালনা করতে শুরু করেন।

১৯৮১ সাল থেকে মোট ১৬ বার 'জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র' পুরস্কার লাভ করে ইউপিএল৷ ১৯৯১ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন৷ পরিবেশ উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৭ জন প্রকাশককে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মহিউদ্দিন ছিলেন তাদের একজন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ 'অ্যাকাডেমিক অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন' থেকে তাকে 'ইমেরিটাস পাবলিশার' পদবি দেওয়া হয়৷

নিজের যোগ্যতার পাশাপাশি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সটি প্রেসের সঙ্গে যুক্ততা তার চোখ খুলে দিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতকে তিনি কতটা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা জানতে মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর কয়েকদিন পর (২৭ জুন ২০২১) দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয় জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক নিয়াজ জামান, অধ্যাপক আলী রীয়াজ, মফিদুল হক, অধ্যাপক আহরার আহমেদ অধ্যাপক ফকরুল আলমের সঙ্গে।

জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, সভাপতি বাংলা একাডেমি

যতদূর মনে পড়ে মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথমে বাইরে ছিলেন। প্রকাশনা বিষয় নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে নিজেই প্রকাশনা সংস্থা 'ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড' প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রায় সবগুলো প্রকাশনার মান অত্যাধুনিক। তিনি নিজেও একজন আধুনিক মানুষ, সেটা তার কাজ দেখলে পরিষ্কার হয়। প্রকাশনা জগত একজন শিক্ষিত মানুষের ভূমিকায় যে কতটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে তার দৃষ্টান্ত মহিউদ্দিন আহমেদ।

নিয়াজ জামান, অনুবাদক, গবেষক ও অধ্যাপক, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মহিউদ্দিন আহমেদ কেবলমাত্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ইংরেজি ভাষার বইয়ের প্রকাশকই নয়, প্রফেশনাল পাবলিশার বলতে যা বুঝায় তিনি তাই। একটি পাণ্ডুলিপির যাচাই-বাচাই করা, রিভিউয়ারের কাছে পাঠানো, সঠিক সম্পাদনা হয়ে বই প্রকাশের বিশাল কর্মযজ্ঞটি অত্যন্ত দক্ষতায় করতেন তিনি।

শুধু তাই নয় রয়্যালিটির বিষয়টা ছিল একেবারে নিয়মিত। তা প্রাপকের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দিতেন। তিনি অনেককে প্রকাশক হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। দুঃখের বিষয় তার আদর্শ আমরা ভুলে গেছি। তার ধারায় কাজ করার মানুষ খুব কম দেখা যাচ্ছে।

আলী রীয়াজ, ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

মহিউদ্দিন আহমেদের পরিচয় আমার কাছে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিবেদিত একজন মানুষ হিসেবে। বাংলাদেশে বাংলাদেশ বিষয়ে যেসব কাজ হচ্ছে, তার সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, একইসঙ্গে পৃথিবীতে বাংলাদেশ বিষয়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে, তাকে বাংলাদেশের পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া—এটাই তিনি করেছেন সারা জীবন। এক বাক্যে যত সহজে তা লেখা যায়, সেই কাজ করা যে কতটা কঠিন, সেটা কেবল তার কাজের প্রভাব থেকেই উপলব্ধি করা সম্ভব। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একাগ্র চিত্তে তিনি তাই করেছেন। বৈষয়িক সাফল্য নয়, স্বীকৃতির প্রত্যাশা নয়, ভালোবাসা ও কর্তব্য বোধই ছিল তার চালিকাশক্তি।

মফিদুল হক, লেখক, গবেষক, প্রকাশক এবং ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন করছি। দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু আমাদের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা তৎসংশ্লিষ্ট বিদ্বৎগোষ্ঠী অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস অথবা কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসের ধারায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অভাব এককভাবে পূরণ করেছেন মহিউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক হলেও প্রকাশনা, দৃষ্টিভঙ্গি, গ্রন্থ বাছাই ও উপস্থাপনে তিনি ছাপিয়ে গিয়েছিলেন এবং জাতীয় মাপকাঠি হয়ে উঠেছিলেন, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিমাপযোগ্য।

আহরার আহমেদ, গবেষক, প্রাবন্ধিক এবং মহাপরিচালক, জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন

মহিউদ্দিন আহমেদের চিন্তার গভীরতা ও ব্যাপ্তি অনেক, তা বলার অবকাশ রাখে না। তবে ৩টি কারণে তার গুরুত্ব আমার কাছে। প্রথমত, প্রকাশনাকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিনোদন নয় জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণে কাজ করেছেন। তার প্রকাশনা উপস্থিত করেছেন উচ্চাসনে। দ্বিতীয়ত, দেশীয় বাজারে আন্তর্জাতিক বইকে সহজলভ্য করেছেন। ব্যক্তিগত শিক্ষা-দীক্ষায় বইয়ের যোগাযোগ স্থাপন করেছেন সারা পৃথিবীতে। তৃতীয়ত, যেহেতু কেবলমাত্র তিনি প্রকাশক নন, লেখকও। ফলে সৃজনশীল ভাবনায় আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। বিদেশের বাজারে আমাদেরকে কারো দ্বারস্থ হতে হচ্ছে না। নিজের দেশেই আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা প্রকাশক পেয়েছি।

ফকরুল আলম, অনুবাদক, ইউজিসি অধ্যাপক, পরিচালক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি এবং সাবেক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মহিউদ্দিন আহমেদের মতো মানুষ আর হবে না। তার চিন্তা, আদর্শ অন্যরকম। প্রকাশক হিসেবে তার পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতা অসামান্য। দুটো একসঙ্গে পাওয়া যায় না আজকাল। আমার দুটি বই প্রকাশ করেছে ইউপিএল। একটি 'বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী', আরেকটি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে। তাদের প্রকাশনার মানে অভিভূত আমি। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে তিনি কাজ করতেন সব সময়। কেবল প্রকাশনা না, বইয়ের বিষয় বৈচিত্রতা ছিল। সমাজ, সংস্কৃতি উন্নয়নে, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমকালীন ইতিহাস, দেশের উন্নয়ন বিষয়ক অসাধারণ সব বই প্রকাশ করতেন। লেখক, পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করতেন, রিভিউয়ারের কাছে পাঠাতেন। বিষয় নির্বাচন, সম্পাদনা, প্রকাশনা ও সঠিক সময়ে সম্মানী—এসবে তিনি বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, লেখক ও প্রকাশকের সম্পর্ক নির্মাণ কতটা উদার হতে পারে তা উনাকে না দেখলে, না মিশলে বুঝাই যেতো না। তার স্নেহ, বোধ, চিন্তাশক্তি, কাজের ধরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার এতোটা কাছে চলে গিয়েছিলাম যে এক সময় তাকে ভাই-ই মনে করতাম।

Comments

The Daily Star  | English

Dozens of zombie firms still trading as if nothing is wrong

Nearly four dozen companies have been languishing in the junk category of the Dhaka Stock Exchange (DSE) for at least five years, yet their shares continue to trade on the country’s main market and sometimes even appear among the top gainers. 

3h ago