বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে রপ্তানি পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি অংশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধাক্কা লেগেছে। এর ফলে আসন্ন বড়দিনের বিক্রির মৌসুমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি চালান ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, আমদানি করা নমুনা ও উৎপাদনের উপকরণগুলো আগুনে পুড়ে যাওয়ায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের উৎপাদন কাজ থেমে যেতে পারে। এতে পণ্য ডেলিভারিতে দেরি হতে পারে এবং অনেক অর্ডারও বাতিল হওয়ার ঝুঁকি আছে।

শিল্পসংশ্লিষ্টদের ধারণা, শাহজালাল বিমানবন্দরে পুড়ে যাওয়া মালামালের ক্ষতির হিসাব প্রাথমিকভাবে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ঢাকার এই বিমানবন্দরের আগুন ছিল গত এক সপ্তাহে তৃতীয় বড় দুর্ঘটনা, যা ব্যবসায়ীদের বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে বাড়তি শুল্ক, ঋণের সুদ বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও দেশীয় বাজারে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে বাণিজ্য খাত সংকটে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের ওপর নতুন করে আরোপিত ২০ শতাংশ শুল্ক। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার।

বিমানবন্দরে এই আগুন শুধু দেশের সুনামকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও সুবিধা করে দেবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ক্ষতিকে শুধু পুড়ে যাওয়া পণ্যের আর্থিক মূল্য দিয়ে বিচার করা যাবে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো রপ্তানিমুখী পোশাক ও ওষুধ শিল্পে, এমনকি স্থানীয় বাজারনির্ভর ব্যবসাগুলোতেও।

আমদানি কার্গো অঞ্চলে পোশাকের লেইস বা আনুষঙ্গিক সামগ্রী থেকে শুরু করে স্পেয়ার পার্টস, নতুন অর্ডারের নমুনা— সবকিছুই সংরক্ষিত ছিল। পোশাক কারখানাগুলো সময়মতো পণ্য পাঠাতে বিমান পরিবহনের ওপর নির্ভর করে। ফলে আগুনের প্রভাব তাদের জন্য আরও জটিল ও গুরুতর হয়ে উঠল।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) সাবেক সহসভাপতি নুরুল আমিন সতর্ক করেন, 'আগুনের কারণে বিপুল পণ্য আটকে যাওয়ায় এ বছর বিমান পরিবহনের চাপ আরও বেড়ে যাবে।' তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে ধর্মঘটের কারণে আগেই অনেক পণ্য শাহজালাল বিমানবন্দরে স্থানান্তর করা হয়েছিল।

সাধারণত প্রতিদিন বিমানবন্দরে এক হাজার টন পর্যন্ত শুকনো পণ্যের ব্যবস্থা করা হয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির মৌসুমে এই পরিমাণটা আরও বেড়ে যায়। এখন পুড়ে যাওয়া উপকরণ দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা আবারও শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো চাপ বাড়াবে।

শিল্পখাতের নেতারাও দ্রুত সমাধান খুঁজছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক ফয়সাল সামাদ জানান, কার্গো অতিরিক্ত হওয়ার কারণে এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সরকার সাময়িকভাবে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে গুদামের জায়গা বরাদ্দ করেছে।

ফয়সাল সামাদ জানান, যদিও রপ্তানি অংশ অক্ষত ছিল, তবে গুরুত্বপূর্ণ নমুনা ধ্বংস হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করতে বা নবায়ন না-ও করতে পারেন, যা পুরো খাতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিনের কাছ থেকে সরকারিভাবে সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে। সংগঠনটি সদস্যদের ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করছে।

তিনি দ্রুত সরকারি তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেন, 'বিমানবন্দরের সংবেদনশীল এলাকাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার না করলে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা পুনরুদ্ধার কঠিন হবে।'

তাৎক্ষণিক চাপ কমানোর জন্য বিজিএমইএ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে বিমানবন্দর থেকে সব আমদানি করা মালামাল সরিয়ে নেয়। সেইসঙ্গে সরকার পুরো প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য কার্গো ভিলেজকে সপ্তাহজুড়ে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

বড় পরিসরে প্রভাব

পোশাক শিল্পের পাশাপাশি পুড়ে গেছে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল ও টেলিকম যন্ত্রাংশ।

হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মুহাম্মদ হালিমুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই অগ্নিকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বড় বড় ওষুধ কোম্পানির কাঁচামালের চালান সেখানে ছিল। এগুলোর অনেকগুলোই সময়নির্ভর ও তাপমাত্রা-সংবেদনশীল উপকরণ।

হালিমুজ্জামান বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ পদেও আছেন। তিনি বলেন, 'একটি চালান নষ্ট হলেও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।' তিনি সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন, বিশেষ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন দ্রুত দেওয়ার মাধ্যমে আমদানি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য।

তিনি বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যেই এপিআই (অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট) উৎপাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এখন সরকারের সহায়তা দরকার, যেন সরবরাহ ব্যাহত না হয়।'

বিকল্প টার্মিনাল ব্যবহার করার সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, 'এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো সাপ্লাই চেইন দ্রুত পুনঃস্থাপন করা।'

স্যালভেশন লজিস্টিকসের কাস্টমস কোঅর্ডিনেটর মিজানুর রহমান বলেন, 'আমাদের ৪০টি চালানের সবগুলোই আগুনে পুড়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো সব টেলিকম সামগ্রী, যা বিভিন্ন অপারেটরদের কাছে সরবরাহ করার কথা ছিল। আমাদের ক্ষতি ১০ লাখ টাকার বেশি হতে পারে।'

জেন ট্রেডিং লিমিটেডের বেলাল হোসেন পোশাক ও বিদেশি আমদানি বিষয়ক ক্লিয়ারিং ও ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। তিনি জানান, তার ক্লায়েন্টদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার পণ্য আগুনে নষ্ট হয়ে গেছে।

ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট নিজাম ভূঁইয়া বলেন, 'কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়েছে। ভিতরে না ঢুকলে ক্ষতির পরিমাণ আন্দাজও করা যাবে না।'

মাতাতা ট্রেডিং কোম্পানির ইনচার্জ মোহাম্মদ রফিক জানান, তারা প্রায় ৩০ কোটি টাকার শুল্ক দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কিন্তু আগুনে তাদের ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে।

তিনি বলেন, 'এসব ছিল উচ্চমূল্যের মোবাইল যন্ত্রাংশ। আইসি, ডিসপ্লে ও অন্যান্য উপকরণ, যেগুলো ওপ্পো, শাওমি, ভিভো, স্যামসাং, ওয়ানপ্লাস ও রিয়েলমির মতো ব্র্যান্ডের।'

অগ্নিনির্বাপণে বিলম্বের অভিযোগ

ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিস দেরিতে সাড়া দেওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ এত ভয়াবহ হয়েছে।

সংগঠনটির বিবৃতিতে বলা হয়, 'দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিভিল এভিয়েশন ও ফায়ার সার্ভিস সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সমন্বয়ের ঘাটতির কারণেই এই অপূরণীয় ক্ষতি।'

আগুন নেভাতে দেরি হওয়ার অভিযোগ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বশির উদ্দিন বলেন, 'সব দিক বিবেচনা করে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে। আগুন লাগার খবর পাওয়ার মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের দমকল বাহিনী কাজ শুরু করেছিল। ৩৭টি ইউনিট আগুন নেভাতে অংশ নিয়েছিল এবং অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করেছিল ওয়াসা।'

Comments

The Daily Star  | English

Ocean of mourners gather to pay tribute to Khaleda Zia

Crowds spilled over into surrounding areas, with large gatherings seen in Farmgate, Karwan Bazar and nearby localities

2h ago