গ্যাসের সিস্টেম লসে এক বছরে ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকা

ছবি: সংগৃহীত

সিস্টেম লসের কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যত গ্যাস অপচয় হয়েছে, তা দিয়ে ৩০ লাখ রান্নার চুলায় টানা এক বছর তিন বেলা রান্না করা যেত।

গত অর্থবছরে দেশে প্রায় এক হাজার ৭৯৬ মিলিয়ন ঘনমিটার (এমএমসিএম) গ্যাস অপচয় হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে গ্যাসের গড় বিক্রয়মূল্যের হিসেবে, এই অপচয়ের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৪ হাজার ১০৭ কোটি টাকা।
 
বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে 'সিস্টেম লস' বলতে চুরি ও অবৈধ সংযোগ, পুরোনো পাইপলাইনে গ্যাস লিক হওয়া, রক্ষণাবেক্ষণের সময় ক্ষতি, মিটারিং ত্রুটি এবং ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতায় গ্যাসের অপচয়কেই বোঝায়।

শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সিস্টেম লস এত বিশাল পরিমাণের যে, তা দিয়ে প্রায় ২০টি নতুন গ্যাস কূপ খনন করা যেত বা ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুই থেকে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো সম্ভব হতো।

এই সিস্টেম লস কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে ২০২১ অর্থবছর থেকে সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই লসের হার বাড়ছেই।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সিস্টেম লস অনুমোদন করে। কিন্তু গত অর্থবছরে এটি দৈনিক গড় সরবরাহের প্রায় ৭ শতাংশে দাঁড়ায়।

গ্যাস সংকটে পরিবারগুলো তিনবেলা রান্না করতে হিমশিম খাচ্ছে। আর শিল্পখাত সীমিত গ্যাস সরবরাহের কারণে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপচয় হচ্ছে। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে হিসাব বহির্ভূত গ্যাসের পরিমাণ ছিল প্রায় এক হাজার ৫৯৭ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯৭৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। প্রতি বছর দেশের জন্য এই ক্ষতি কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সমান।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিদ‍্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সরকারি ব্যবস্থাপনায় সিস্টেম লস কমানোর প্রচেষ্টায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।

ঢাকায় বিদ্যুৎ ভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, অভিযান চালিয়ে অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদের পরপরই আবার একই স্থানে অবৈধ সংযোগ বসানো হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লস ভলিউমের দিক থেকে সর্বোচ্চ। গত অর্থ বছর এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশে। আগের বছর ছিল ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পেট্রোবাংলার প্রাথমিক প্রতিবেদনে এমনটিই উঠে এসেছে।

ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে গ্যাস সরবরাহকারী তিতাস গত অর্থবছরে সিস্টেম লসে আনুমানিক তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতিতে পড়ে।

তিতাসের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা শহর এবং নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর ও মুন্সিগঞ্জের মতো এলাকায় হাজারো অবৈধ সংযোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। মনিটরিং দল নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এই সংযোগ কেটে ফেলে। তবে সামগ্রিক প্রভাব খুবই কম।

গত অর্থবছরে তিতাস প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার অবৈধ গৃহস্থালি সংযোগ এবং ৫৭৬টি বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে দুই লাখ ৯১ হাজার ও ৬৩৮।

কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, গত বছরের জুলাই-আগস্ট থেকে কয়েক মাস অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ অভিযানে ধীরগতি ছিল। যা সামগ্রিক অর্থবছরের হিসেবে প্রভাব ফেলেছে।

দ্য ডেইলি স্টার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজের মন্তব্যের জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেছে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি।

এর আগে পারভেজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, কোম্পানির প্রধান অগ্রাধিকার হলো সিস্টেম লস কমানো, যা অবৈধ সংযোগ কেটে ফেলা এবং পুরনো, ফাঁস হওয়া পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সম্ভব।

যদিও তিতাস ভলিউমের দিক থেকে সর্বোচ্চ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, তবে শতাংশের দিক থেকে তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।

গত অর্থবছরে বাখরাবাদের সিস্টেম লসের পরিমাণ ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এই কোম্পানি কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের ৩৫টি উপজেলায় গ্যাস সরবরাহ করে।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলে আলম জানান, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে, কারণ এ বছরের সেপ্টেম্বরে সিস্টেম লস ৬ শতাংশে নেমেছে।

আলম বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ পাইপলাইন অন্তত ৫০ বছর আগে স্থাপন করা হয়েছিল। বিতরণ ব্যবস্থায় অনেক লিকেজ আছে… এগুলো প্রতিস্থাপন বা মেরামত করা হলে পরিস্থিতি উন্নতি হবে।

তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলের অনেক বাসিন্দা মনে করেন তাদের অবৈধ গ্যাস নেওয়ার 'অধিকার' আছে, কারণ এখানে দেশের বেশিরভাগ গ্যাসক্ষেত্র অবস্থিত। 'আমাদের এমন মানসিকতা বদলাতে হবে, যাতে জাতীয় সম্পদ অবৈধভাবে ব্যবহার না হয়,' তিনি যোগ করেন।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ছয়টি গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান মিলিতভাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯৬ হাজারের বেশি অবৈধ গৃহস্থালি সংযোগ ও ৫৪১টি অবৈধ শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।

এ ছাড়া সারা দেশে ১৯৭ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন অপসারণ হয়েছে। পেট্রোবাংলা নেটওয়ার্কে ২৫ হাজারের বেশি লিকেজ শনাক্ত ও মেরামত করেছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ছয়টি বিতরণকারীর আওতায় প্রায় ৪৩ লাখ গৃহস্থালি গ্যাস সংযোগ রয়েছে। নতুন আবাসিক সংযোগ ২০০৯ সাল থেকে স্থগিত রয়েছে, কারণ এ ধরনের সরবরাহের লাভ শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগের তুলনায় কম।

দ্য ডেইলি স্টার পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমানের মন্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। তবে একাধিক ফোনকলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Dozens of zombie firms still trading as if nothing is wrong

Nearly four dozen companies have been languishing in the junk category of the Dhaka Stock Exchange (DSE) for at least five years, yet their shares continue to trade on the country’s main market and sometimes even appear among the top gainers. 

1h ago