চাকরির নিরাপত্তা ছাড়াই কাটল আরও একটি বছর

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৫৮ পদে চাকরির সুযোগ
ছবি: সংগৃহীত

কারখানা বন্ধ, গণহারে ছাঁটাই, স্বল্প বেসরকারি বিনিয়োগ এবং মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ২০২৫ সাল শেষ হচ্ছে চাকরির বাজারে পুনরুদ্ধারের কোনো সুখবর ছাড়াই। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক—উভয় খাতেই কর্মসংস্থানের সংকট এ বছর আরও গভীর হয়েছে।

বেকারত্ব সমস্যা বছরের পর বছর ধরে একটি বড় সংকট হিসেবে বিরাজ করছে। যে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, তার পেছনেও অন্যতম বড় কারণ ছিল চাকরিহীনতা। সেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দেড় বছর পর কর্মসংস্থানের সূচকগুলো বলছে, ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি।

পুরো বছরের পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো পাওয়া না গেলেও সরকারের একটি অভ্যন্তরীণ জরিপ বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ২৪৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় এক লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

একই সময়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও ময়মনসিংহে প্রায় ৯৩৭টি নতুন কারখানা চালু হয়েছে। অস্থিরতার মধ্যেও এটা বিনিয়োগের ইঙ্গিত দেয়। তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, এগুলোর বেশির ভাগই ক্ষুদ্র পরিসরের উদ্যোগ।

তিনি বলেন, 'এগুলো বড় বিনিয়োগ নয়। খুব কমই বড় কারখানা হয়েছে। যা বেড়েছে তা হলো ছোট ও কম গুরুত্বপূর্ণ। অর্থবহভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনা ঘটেনি।'

সুলতান উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক, আর্থিক দুর্বলতা এবং পরিচালনগত চ্যালেঞ্জের কারণে এসব শিল্পের পশ্চাৎ ও সম্মুখ সংযোগ শিল্পগুলোও (ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ) ধুঁকছে।

আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ায় কাজ হারানো অনেকেই সংসার চালাতে অনানুষ্ঠানিক কাজে ঝুঁকছেন। বিলসের নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'ব্যাটারিচালিত রিকশা ও মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং চালকের সংখ্যা হঠাৎ অনেক বেড়ে যেতে দেখছি আমরা।'

বিদায়ী বছরে বেশ কিছু বড় কারখানা বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। আর্থিক ও পরিচালনগত তীব্র সংকটের মুখে গত সেপ্টেম্বরে নাসা গ্রুপ ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে তাদের ১৬টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়। এর ফলে তৈরি পোশাক খাতের সাড়ে ১২ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারান। বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত গ্রুপটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বর্তমানে কারাগারে আছেন।

আরেক বড় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপেও ছাঁটাই অব্যাহত ছিল। কার্যাদেশ না থাকার কারণ দেখিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে বেক্সিমকো লিমিটেড গাজীপুরে তাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পাঁচটি ইউনিটে প্রায় আট হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়। এর আগে ২০২৪ সালের শেষের দিকে ১৫টি পোশাক ইউনিটে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেছিল গ্রুপটি। নাসা গ্রুপের মতো বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও বর্তমানে কারাগারে।

কারখানা বন্ধ ও বকেয়া বেতনের জেরে সরকার এবার অতীতের চেয়ে কঠোর অবস্থান নেয়। প্রথমবারের মতো, শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করে দেশত্যাগ করা মালিকদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারির উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বেক্সিমকো ও নাসাসহ ১১টি কোম্পানির বকেয়া পরিশোধে কেন্দ্রীয় তহবিল ও অর্থ বিভাগ থেকে ৭০৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকার সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও গ্রুপের প্রায় ৩৩ হাজার এবং নাসা গ্রুপের ১৭ হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক তাদের পাওনা পেয়েছেন।

বিলসের নির্বাহী পরিচালক সরকারের এই হস্তক্ষেপকে প্রশংসনীয় উল্লেখ করলেও একে অপর্যাপ্ত বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, কারখানা যাতে বন্ধ না হয়, সে জন্য শুরুতেই একটি সমন্বিত কৌশল নেওয়া প্রয়োজন ছিল।

বিনিয়োগে খরা কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে আরও বাধাগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের বছর ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতির চাহিদা কমে যাওয়া, ব্যবসায় সম্প্রসারণ না হওয়া এবং পরিচালনগত চ্যালেঞ্জের কারণে এই ধীরগতি দেখা গেছে।

অনলাইন চাকরির বাজারেও খুব একটা স্বস্তির খবর নেই। বিডিজবস ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে চাকরির বিজ্ঞপ্তি কমে গিয়েছিল, তবে জুলাই ও আগস্টের পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। বছরের প্রথম ৯ মাসে চাকরির বিজ্ঞপ্তি ৫৫ হাজার ৩৭২ থেকে বেড়ে ৬০ হাজার ৩১২-তে দাঁড়িয়েছে।

বিডিজবস ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, 'সামগ্রিকভাবে ২০২৫ সাল চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য একটি কঠিন বছর ছিল। বছরের প্রথম ছয় মাসে আমাদের প্ল্যাটফর্মে চাকরির বিজ্ঞপ্তি কমে গিয়েছিল। জুলাই-আগস্টের পর কিছুটা উন্নতি হলেও চাকরির বাজার মূলত স্থবির হয়ে আছে।'

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন সদ্য পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা। প্রতিবছর যে সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন, তার তুলনায় এন্ট্রি-লেভেল বা শুরুর পদের চাকরির সংখ্যা অনেক কম।

তবে সরকারি নিয়োগে কিছুটা গতি আসার কথা জানিয়েছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী আব্দুল মান্নান বলেন, '২০২৫ সালে সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তির সংখ্যা তুলনামূলক বেশি ছিল, কারণ আগের বছর দীর্ঘ সময় অস্থিরতা ছিল।' দীর্ঘদিন আটকে থাকা বেশ কিছু পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পাওয়ায় চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে নতুন আশা তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানান।

তবু প্রতিযোগিতা এখনো তীব্র। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের স্নাতক মো. একরামুল হক বলেন, 'প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঢাকায় এসে চাকরির পরীক্ষা দিই। কিন্তু প্রতিযোগিতা প্রচণ্ড। গত সপ্তাহে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন অফিস সহকারী পদের পরীক্ষায় অংশ নিলাম। মাত্র ১৬১টি পদের জন্য আবেদন করেছেন এক লাখের বেশি প্রার্থী।'

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান খাতের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, 'বছরের শুরুতে ২০২৪ সালের সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের কিছু লক্ষণ দেখা গেলেও আবার দ্রুতই গতি হারায় অর্থনীতি।'

তিনি বলেন, 'প্রকৃত মজুরি ক্রমাগত কমতে থাকায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা দ্বিমুখী সংকটে পড়েছেন। আমরা এখন "চাকরিবিহীন প্রবৃদ্ধি" থেকে "প্রবৃদ্ধিহীন ও চাকরিহীন" অর্থনীতিতে উপনীত হয়েছি। এটি কার্যত অর্থনীতির জন্য দুই বছরের ছুটির মতো অবস্থা।'

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, 'অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে মন্থর হয়ে পড়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

তিনি বলেন, আগের বছরগুলোতে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি অর্থবহ কর্মসংস্থান তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন উৎপাদন খাত নিজেই দুর্বল হয়ে পড়েছে, ফলে সম্প্রসারণের সুযোগ কম এবং এ খাতে কর্মসংস্থান কমেছে।

এম এ রাজ্জাক বলেন, 'এখানে দুটি মূল সমস্যা: নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না এবং বিদ্যমান কর্মসংস্থানের সিংহভাগই অনানুষ্ঠানিক ও নিম্ন উৎপাদনশীল। এ ছাড়া গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হারও অনেক বেশি।'

স্বল্প মেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে এবং রাষ্ট্রকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

Comments

The Daily Star  | English

Ocean of mourners gather to pay tribute to Khaleda Zia

People from all walks of life arrive by bus, train and other modes of transport

2h ago