১৯ বছরের পথচলায় মাত্র ২ বছর মুনাফা করেছে টেলিটক

টেলিটক, গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, টেলিটকের লাভ কত, টেলিটকের মুনাফা,

টেলিটকের যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে। তখন এর লক্ষ্য ছিল- দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান মোবাইল টেলিযোগাযোগ খাতের আধিপত্য বিস্তার করা।

রাষ্ট্র পরিচালিত অপারেটরটির সেই যাত্রা বেশ ধুমধামের সঙ্গেই শুরু হয়েছিল। শুধু তাই নয় শুরুর দিকে সাশ্রয়ী প্যাকেজ দিয়ে গ্রাহকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহও তৈরি করতে পেরেছিল।

এক সময় বাজারের শীর্ষে থাকা গ্রামীণফোন ভয়েস কলের জন্য প্রতি মিনিটে ৬ টাকা নিত, টেলিটক তা কমিয়ে ৪ টাকা করেছিল।

এসব সাশ্রয়ী প্যাকেজের কারণে টেলিটক সিমের বিক্রি বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য অপারেটরদের তুলনায় টেলিটক সিমের দামও কম ছিল। ফলে, তখন রাষ্ট্রায়িত অপারেটরটির সিম বিক্রয় কেন্দ্রে মানুষের দীর্ঘ লাইন লেগে থাকত।

তাই টেলিটকের ব্যবসা বাড়াতে অর্থ লগ্নি করে সহায়তা করেছিল সরকার। পাশাপাশি প্রথম অপারেটর হিসেবে বাংলাদেশে থ্রিজি বিস্তার ও ফাইভ-জি সেবা চালুর সুযোগ দেওয়া হয়।

কিন্তু, সরকারের আর্থিক সহায়তা টেলিটকের জন্য কোনো পার্থক্য এনে দিতে পারেনি, বছরের পর বছর ধরে এটি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান লোকসানের কারণে এটি যেন সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অব্যাহতভাবে গ্রাহক হারাতে থাকায় ও বিভিন্ন সার্ভিস মেট্রিক্সে টেলিটকের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ায় নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো আপাতত অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।

গত বছরের ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে টেলিটকের মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিট লোকসানের ধারাবাহিক প্রবণতার প্রতিফলন।

২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, টেলিটক কেবল ২০১০-১১ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে মুনাফা করতে পেরেছিল।

এদিকে টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা, রাজস্ব ও সেবার মান কমে যাওয়ায় তাদের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছে যে, অপারেটরটির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে অডিটর।

অডিটেড আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটরটির লোকসান হয়েছে ১৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৯ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।

গত পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ২০২২ সালে গ্রামীণফোনের নিট মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রবির মুনাফা হয়েছে ১৮৩ কোটি টাকা।

অন্যদিকে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি বাংলালিংক বছরের মুনাফার তথ্য প্রকাশ করেনি। কিন্তু, বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির আয় ১২ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে বলে জানা গেছে।

কেন সংকটে টেলিটক

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাপক সহায়তা ও সুবিধা পেলেও ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে যাচ্ছে টেলিটক। অব্যাহত এই লোকসানের মূল কারণ কম আয়ের বিপরীতে উচ্চ ব্যয়।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, টেলিটকের মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৫০২ কোটি ১ লাখ টাকা, যেখানে ব্যয় হয়েছে ৬৯৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

টেলিটকের এই দুর্ভোগ যেন নতুন কিছু নয়।

২০০৪-০৫ থেকে ২০১০-১১ সাল পর্যন্ত টেলিটকের অডিট চালানোর পর বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, 'টেলিটকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুর্বলতা আছে।'

এতে বলা হয়, শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অপারেটরটির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না।

এতে আরও বলা হয়, 'টেলিটক গুরুতর আর্থিক ঝুঁকিতে আছে, যা কোম্পানির মুনাফা ও স্থায়িত্বের জন্য ক্ষতিকর।'

টেলিটকের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পাওনা ১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে আছে- লাইসেন্সিং ফি, বকেয়া রাজস্ব, স্পেকট্রাম ফি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল পরিশোধ।

টেলিটকের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা থেকে ৯ শতাংশ বেশি।

এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য অপারেটরের গ্রাহক বাড়লেও গ্রাহক হারিয়েছে টেলিটক।

দেখা গেছে, টেলিটকই একমাত্র অপারেটর যারা ২০২৩ সালে গ্রাহক হারিয়েছে। গত বছর এর গ্রাহক বেস ২ দশমিক ৩ লাখ কমে ৬৪ দশমিক ৬ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশের মোট গ্রাহক বেসের ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বিপরীতে অন্য তিন অপারেটরের ভালো পারফরম্যান্সের কারণে গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ৫ লাখ।

মানসম্মত সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপারেটরগুলোর মধ্যে টেলিটক প্রায়ই সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকে।

বিটিআরসির সর্বশেষ ২০২১ সালে দেশব্যাপী পরিচালিত ড্রাইভ-টেস্টের ফলাফল অনুযায়ী, টেলিটকের গড় কল সাকসেস রেট ছিল ৯৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কলড্রপের হার ছিল ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

যদিও বিটিআরসির নীতিমালা অনুযায়ী, কল সাকসেসের হার ৯৭ শতাংশ বা তার বেশি হওয়া এবং কলড্রপ ২ শতাংশের কম হওয়া উচিত।

গত ১৩ জানুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম কোম্পানিগুলোকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে মুনাফা অর্জনের নির্দেশ দেন। অন্যথায় কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের কোম্পানি ছাড়তে হবে বলে জানান তিনি।

টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম হাবিবুর রহমান বলেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যে ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা।

তিনি বলেন, 'টেলিটক বর্তমানে ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে টেলিটকের নেটওয়ার্ক মানের অনেক উন্নতি হবে।'

বিটিআরসির অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের কমিশনার মুশফিক মান্নান চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, টেলিটকের সমস্যা খুঁজে বের করতে চলতি মাসেই ইনফরমেশন সিস্টেম অডিট শুরু করা হবে।

নিয়মনীতি না মানায় টেলিটকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন লিরনেএশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান।

(ইংরেজি থেকে এই প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)

Comments

The Daily Star  | English
Banks and factories closed for Khaleda Zia mourning

Banks, factories to remain closed tomorrow amid national mourning for Khaleda Zia

Banks will remain closed tomorrow after the interim government declared a public holiday as part of a three-day national mourning period following the death of former prime minister Begum Khaleda Zia..Non-bank financial institutions will also remain closed, according to circulars issued by

17m ago